Background

Myspace HTML Codes & Layout Generators
Myspace Backgrounds

হাতিশুঁড়ো

হাতিশুঁড়ো
Hatishuro





উদ্ভিদের নাম : হাতিশুড়, হস্তিশুন্ডি হাতিশুঁড়ো, Hatishuro

স্থানীয় নাম : হাতিশুঁড়ো

ভেজষ নাম : Heliotropium indicum Linn..
d¨vwgwj:- Boraginaceae

ব্যবহার্য অংশ : সমগ্র গাছ

রোপনের সময় : যে কোনো সময় জন্মে।

উত্তোলনের সময় : যে কোনো সময় সংগ্রহ করা যায়।

আবাদী/অনাবাদী/বনজ : অজত্নে যত্রতত্র জন্মে।

চাষের ধরণ : গ্রীষ্মে ফুল হয়। আতি ক্ষুদ্র ফল পেকে ছড়িয়ে বংশ বিস্তার হয়।

উদ্ভিদের ধরণ: ছোট গুল্ম জাতীয় গাছ।

পরিচিতি: বর্ষজীবী ছোট গুল্ম, ভারতবর্ষের অযত্নসম্ভুত অতি সাধারণ গাছ, এক দেড় ফুট উঁচু হয়। এই গাছের কান্ডগুলি ফাঁপা ও নরম। পুষ্পদন্ডেব বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষনীয়। এর পুষ্পদন্ডটি দেখতে হাতির শুঁড়ের মত,তাই হয়ত তার এই নামকরণ হয়েছে।


ঔষধি গুনাগুন :
১। ফুলোয়- হাঠৎ ঠান্ডা লেগে হাতে পায়ের গাঁট ফুলে গেলে (এটা সাধারণতঃ কফের বিকারে হয়) এই হাতিশুঁড়ো পাতা বেটে অল্প গরম করে ঐ সব ফুলোর জায়গায় লাগালে ওটা কমে যায়।
২। আঘাতের ফুলায়- এই পাতা বেটে গরম করে ঐ আঘাতের জায়গায লাগালে ব্যথা ও ফুলো দুইই চলে যায়।
৩। বাগীর ফুলোয়- ঊরু ও তলপেটের সন্ধিস্থানে অর্থাৎ কু’চকীতে যেটা হয় তার নামই বলা হয় বাগী, ডান বা বাম যে কোন দিকেই হতে পারে। সাধারণঃ এটা যৌন সংসর্গের সময় অস্বাভাবিক অবস্থানের জন্য অথাব মেহ বা ঔপসর্গিক মেহ (গণোরিয়া) রোগাগ্রস্ত লোকগুলি এই রোগের বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এক্ষেত্রেও ঐ পাত্য বেটে অল্প গরম করে লাগালেও কমে যায়।
৪। রিউমেটিকে- এই বাতে ফুলো থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। এগুলি সাধারণতঃ অস্থির সন্ধিস্থানে (গাঁটে) বেশী হয়। এ ক্ষেত্রে এরন্ড তৈলের (রেডির তেল) সঙ্গে এই পাতার রস বা পাতা বাটা দিয়ে পাক করে ছেঁকে নিয়ে সেই তৈল গাঁটে লাগাতে হয়। রেডির তেল বৈদ্য দোকানে পাওয়া যায়।
৫। বিষাক্ত পোকার কামড়ে- জ্বালা করে কোন কোন ক্ষেত্রে ফুলেও যায়, সে সময় এই পাতার রস করে লাগালে ওটা কমে যায়।
৬। শ্লেষ্মা জ্বরে- সর্দিতে বুক ভার, সেক্ষেত্রে এই পাতার ২ চামচ একটু গরম করে ছেঁকে নিয়ে খেতে দিতেন প্রাচীন বৈদ্যরা। এর দ্বারা সর্দিটা বমি হয়ে বেরিয়ে যায়।
৭। টায়ফায়েড জ্বরে- পিপাসা ও সঙ্গে মাথা চালাও প্রবল থাকে, এ ক্ষেত্রে ঐ পাতার রস গরম করে ছেকে ঐ রস ১০ ফোঁটায় একটু জল মিশিয়ে খেতে দিতে হয়। আধ ঘন্টা অন্তর দুই/তিন বার খাওয়ালে এই উপসর্গটা প্রশমিত হয়, তবে দুই তনি বারের বেশী খাওয়ানো উচিত নয়।
৮। ফেরিনজাইটিসে- অথবা লেরিন জাইটিস হলে পাতার রস ২ চামচ আধ কাপ অল্প গরম জলে মিশিয়ে গারগেল (মধৎমষব) করতে হয়। প্রত্যহ সকালে বৈকালে দুই বার করতে পারলে ভাল। এমন কি গলার মধ্যে ক্ষত ভাব দেখা দিলে সেটাও সেরে যায়। তবে এসব ক্ষেত্রে এর সঙ্গে ২/৩ চামচ বাসক পাতার রস একটু গরম করে প্রত্যহ একবার করে খেতে পারলে কফের বিকারটা নষ্ট হয়।
৯। এক্জিমায়- এই পাতার রস লাগালে কমে যায়।

চিরঞ্জীব বনৌষধী
আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য
১ম-খন্ড, পৃষ্ঠা-২৭৬


মাহমুদুল হক ফয়েজ
মুঠোফোনঃ ০১৭১১২২৩৩৯৯
e-mail:- mhfoez@gmail.com

বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্যসেবা ও পরিচর্যা




এক নজরে গবেষণা

গবেষণার শিরোনাম:- বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্যসেবা ও পরিচর্যা
গবেষক :- মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ
স্থান:- নোয়াখালী সদর ও এর পার্শ্ববর্তী তিনটি উচ্চ বিদ্যালয়
সময় কাল: আগষ্ট, সেপ্টেম্বর ২০০৮
গবেষণায় অংশগ্রহণকারী: তিনটি স্কুলের ৩৬ জন কিশোর কিশোরী এবং
সংশ্লিষ্ট ৩৬ জন অভিভাবক
গবেষণার পদ্ধতি: অংশগ্রহণমূলক কর্ম গবেষণা


বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্যসেবা ও পরিচর্যা
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

ভূমিকা
মানুষের জীবনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবর্তন আসে। যেমন - ছোটবেলা একরকম, কিশোর বয়সে একরকম, আবার বড় হয়ে যাওয়ার পর অন্যরকম। তবে, সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন আসে কৈশোরে। শিশুকাল আর যৌবনের মাঝামাঝি সময়কে বয়ঃসন্ধি কাল বা কৈশোরকাল বলে। এরা কিশোর কিশোরী। এ বয়সে এরা আরো বেশি বুঝতে শেখে। অনুভব করতে শেখে, বাইরের পৃথিবী এবং জীবন সম্পর্কে আরো বেশি জানতে চায়।
১০ বছর থেকে ১৯ বছর পর্যন্ত সময়কে বলে বয়ঃসন্ধি কাল। কেউ বলে উঠতি বয়স। শরীরের গঠন আর পুষ্টির উপর ভিত্তি করে সাধারণত ১০-১২ বছর বয়সে এদের শারীরিক পরিবর্তন শুরু হয়।
এ সময় কিশোর -কিশোরীরা বেড়ে উঠে। একেক জনের শরীর যেহেতু একক রকম। তাই কেউ বড় হয় তাড়াতাড়ি আর কেউ বা একটু দেরীতে। দেহের চাহিদা অনুযায়ী এ সময়ে পুষ্টিকর ও সুষম খাবার গ্রহণ করলে শরীরের বৃদ্ধি পুরোপুরি হয়।
এ বয়সে ছেলেদের উচ্চতা বাড়ে, কাঁধ চওড়া হয়, মাংসপেশী শক্ত হতে থাকে। মুখে দাড়ি গোঁফ গজাতে শুরু করে ও কন্ঠস্বরের পরিবর্তন হয়।
মেয়েদের শরীর ও এ বয়সে বাড়তে থাকে। মেয়েলি পরিবর্তনগুলো শুরু হয় এবং চেহারায় লাবন্য আসে। এই পরিবর্তনগুলি হচ্ছে একটি ছেলে বা মেয়ের বড় হওয়ার লণ। বয়ঃসন্ধিকাল মানুষের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক পরিবর্তন ঘটার ফলে মানসিক পরিবর্তনও শুরু হয়। এ সময় তাদের মনে নানা প্রশ্ন উঁকি দেয়। মন চঞ্চল হয়ে উঠে। মনের ভিতর দ্বিধা দ্বন্দ্ব আর আবেগ অস্থিরতা বেশি কাজ করে। এসময় ছেলেমেয়েরা নিজেদের বড় ভাবতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবে এ বয়সে তারা শরীর, চেহারা, পোশাক ও আচার-আচরণ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। কখনো মন বিষন্ন হয়ে উঠে আবার কখনো মন খুশিতে ভরে যায়। এসময় অনেকে একা থাকতে চায়। কারো সাথে মিশতে চায় না। আবার দল বেঁধে হৈচৈ করে অন্যেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় এরা। তাদের মনে স্বাধীন ও স্বনির্ভর হওয়ার ভাবনা আসে। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে ও মেয়েদের সাথে বাবা-মা ও পরিবারের আচরনের তারতম্য বেশি দেখা যায়
আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছেলে এবং মেয়েদের সমান চোখে দেখা হয় না এবং তাদের সাথে একই রকম ব্যবহার করা হয় না। জন্মের পর থেকে মেয়েরা বিভিন্ন ভাবে বৈষম্যের শিকার হয়।
এসময় মেয়েরা নিরাপত্তার অভাবে ভোগে। কেউ কেউ এ সময় যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। অনেক সময় যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক ছেলে বা মেয়ে মানসিকভাবে কষ্ট পায়। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে এবং স্বাভাবিক হতে পারে না।
তাই এসময় নিজের চিন্তা এবং সমস্যাগুলি যদি পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে আলাপ করে নেয়া যায় এবং সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী করা যায়। তাহলে বিভিন্ন সমস্যা সহজে সমাধান করা যায়।


ল্ক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
বয়ঃসন্ধিকাল মানুষেরে জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময়। এবয়সে একটি ছেলে বা মেয়ে প্রবেশ করে এক অজানা জগতে। চরম কৌতুহল নিয়ে সে দেখে তার চারদিকের পৃথিবীকে। এ সময় তার শারিরীক ও মানসিক অভুতপূর্ব পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু আমাদের দেশের সামাজিক প্রোপটে এ সময়টা থাকে সবচেয়ে বেশী উপেতি। কিশোর কিশোরীরা অজ্ঞতার কারনে সঠিক পরিচর্যা পায়না। শহর ও গ্রামের এলাকা ভেদে এদের চাল চলনের ধরণ হয় আলাদা। সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই এরা দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে। অবিভাবকরাও এ বয়সকে সহজ চোখে দেখতে চান না। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা থাকেন একেবারে উদাসিন। আবার মেধা বিকাশেও চরম বাধার সম্মুখে পড়তে হয় এদের। তখন নষ্ট হয় উজ্জল সম্ভাবনা। জাতি হয় তিগ্রস্ত।
এ পরিপ্রেক্ষিতে নোয়াখালী জেলার শহর শহরতলী ও গ্রাম পর্যায়ের তিনটি স্তরের এই কিশোর কিশোরীদের বিভিন্ন সমস্যা ও এর সমাধানের পথ অনুসন্ধান এবং তাদের অবিভাবকদের মানসিকতা পর্যালোচনা করাই ছিলো এই গবেষণার মূল ল্য ও উদ্দেশ্য।


সমীক্ষা ও পদ্ধতি
এ গবেষণাটি সম্পূর্ণ অংশগ্রহণমূলক কর্ম গবেষণার পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়েছে। এটি পার্টিসিপেটরি একশান রিসার্স(পার) বা অংশগ্রহণমূলক কর্ম গবেষণা। এ গবেষণাটিতে কোনো ভাবেই গতানুগতিক অন্যান্য গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। এ গবেষণার জন্য নোয়াখালী শহর, গ্রাম ও শহরতলীর তিনটি স্কুলকে বাছাই করা হয়েছে। এসব স্কুলে রয়েছে সহ-শিা বা কো-এডুকেশন। প্রতিটি স্কুল থেকে ১২ জন করে শিার্থী বাছাই করা হয়েছে। দুটি স্কুল থেকে নেয়া হয়েছে ১২ জন করে মোট ২৪ জন কিশোরী এবং একটি স্কুল থেকে নেয়া হয়েছে ১২ জন কিশোর। প্রতিটি স্কুলে এই ১২ জনকে নিয়ে গ্র“প করা হয়েছে। আবার স্কুলের এই শিার্থীদের অবিভাবকদের নিয়ে ১২ জন করে এক একটি গ্র“প করা হয়েছে। অর্থাৎ তিনটি স্কুলের ১২ জন করে তিনটি গ্র“প এবং ঐ শিার্থীদের ১২ জন অভিবাবক নিয়ে তিনটি গ্র“প। শিার্থী ও অভিবাবক নিয়ে আলাদা করে মোট ৬টি গ্র“প করা হয়েছে। এদের প্রত্যেকের সাথে আলাদা আলাদা করে কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিটি গ্র“পে ৩টি করে মোট ১৮টি কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিলো। কর্মশালার পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছিলো অংশগ্রহনমূলক কর্মগবেষণা পদ্ধতি। যারা এই কর্মগবেষণায় অংশগ্রহন করে তারাই মূলত এর গবেষক। যেহেতু এ বিষয়টি খুবই সংবেদনশীল বিষয় তাই অংশগ্রহনকারীরা এ বিষয়টি নিয়ে সাচ্ছন্দবোধ নাও করতে পারে, এই ধারনা থেকে একজন অভিজ্ঞ নারী এনিমেটর তাদের সাথে সার্বণিক সঙ্গ দিয়ে একে আরো সচল করে রেখেছিলো।


যে সব স্কুলে গবেষণার কর্মশালা করা হয়েছিলো
১. এম,এ,সাত্তার উচ্চ বিদ্যালয়
ফতেপুর, ৩ নং ওয়ার্ড
নোয়াখালী পৌরসভা
সদর উপজেলা
নোয়াখালী
২. আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়
লক্ষীনারায়ণ পুর
কাদির হানিফ ইউনিয়ন
সদর উপজেলা
নোয়াখালী

৩.হাসান হাট উচ্চ বিদ্যালয়
শরিফ পুর ইউনিয়ন
উপজেলা - বেগমগঞ্জ
নোয়াখালী


এলাকার ভৌগোলিক ও অর্থসামাজিক পরিচয়
উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী শিক্ষা দীক্ষায় অগ্রসরমান একটি জেলা হিসাবে সুপরিচিত। আবার চরম ধর্মীয় অনুভূতিশীল জেলা হিসাবেও অনেকে একে চিহ্নিত করে থাকেন। তবে নোয়াখালী শহর ও গ্রামের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যায়। জেলার গ্রামাঞ্চলে এখনো অনেক গোঁড়ামীর লক্ষণ দেখা যায়। তবে পর্যবেক মহল মনে করেন, নোয়াখালী শহরের জনজীবণ দেশের অন্যান্য জেলা শহরের তুলনায় অনেক শান্ত, আধুনিক এবং প্রগতিশীল। এলাকা ভেদে এর ব্যতিক্রমও আছে। জেলায় বর্তমানে শিক্ষার হার ধীরে ধীরে অনেক বাড়ছে। নিম্ন বিত্তদের মাঝে শিক্ষার প্রতিও আগ্রহ অনেকাংশে বেড়েছে। এ অঞ্চলে বর্তমানে মেয়েদের শিক্ষা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে। যে সব স্কুলে গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছে সে সব স্কুলে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা বেশী। এসব স্কুলের ছাত্রীদের তুলনায় ছাত্রদের ঝরে পড়ার হার বেশী।


সেপ্টেম্বর ২০০৮ পরিসংখ্যান অনুযায়ী তিনটি স্কুলের ছাত্রছাত্রী সংখ্যা
স্কুল ছাত্র ছাত্রী মোট
হাসান হাট উচ্চ বিদ্যালয় ৩০২ ৩৯৯ ৭০১
আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ১৮০ ২০৭ ৩৮৭
এম,এ,সাত্তার উচ্চ বিদ্যালয় ১৪১ ২৫৭ ৩৯৮

যারা গবেষণার কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে-

এম,এ,সাত্তার উচ্চ বিদ্যালয়
১.তসলিমা আক্তার
২.নূরজাহান আকতার
৩.সুলতানা ইয়াসমীন
৪.বিবি ফাতেমা(বীথি)
৫.বিবি ফাতেমা(রুপালী)
৬.বিবি রহিমা(নিপু)
৭.ফারজানা ইয়াসমীন(রুমি)
৮.কাউছার আক্তার
৯.প্রমা পাল
১০.শাহনাজ আক্তার
১১.মমতাজ
১২.বিবি কুসুম

হাসান হাট উচ্চ বিদ্যালয়
১.রোখসানা আক্তার(মুন্নি)
২.সাহিদা আক্তার মলি
৩.বিবি আয়েশা
৪.বিবি মরিয়ম
৫.নূর ন্হার বেগম
৬.তহমিনা আক্তার সুবর্ণা
৭.নাছরিন আক্তার
৮.জান্নাতুল ফেরদৌস ফেরদৌসী)
৯.নাছরিন সুলতানা(পলি)
১০.নিলুফা ইয়াসমিন(নিশি)
১১.সঞ্জিদা আমিন(প্রাপ্তি)
১২.জান্নাতুল ফেরদৌস(নিশু)

আদর্শ হাই স্কুল
১.নিজাম উদ্দিন
২.আবদুল্লাহ আল নোমান
৩.মো:সাজ্জাদ হোসেন(সাজু)
৪.আবদুল্লাহ আল মামুন
৫.শাহদাত হোসেন
৬.মো:রোকন উদ্দিন
৭.মোহাম্মদ হাসান
৮.মো:হিমেল
৯.মো:সুজন
১০.মো:শামীম
১১.সিরাজুল হক
১২.মীর্জা এনামুল মজিদ

অভিভাবকদের মধ্যে অংশগ্রহণ করেন ছাত্র ছাত্রীদের অভিভাবক এবং এলাকার অন্যান্য অভিভাবক ও শিকগণ। এছাড়াও এনিমেটর হিসাবে সকল কর্মশালায় সঞ্চালক হিসাবে ছিলেন তৃণমূল সংবাদকর্মী রাবেয়া সুলতানা নাজনীন।


প্রাক প্রস্তুতি
কর্মশালা শুরুর আগে আমরা প্রত্যেক স্কুলের শিক ও কয়জন অভিভাবকদের নিয়ে আলোচনা করি। সে সময় তাঁদেরকে গবেষণার বিষয়টি ও এর গুরুত্ব সম্পর্কে বিষদ ব্যাখ্যা করা হয়। তাঁরা সকলেই এ বিষযটি নিয়ে এ ধরনের গবেষণার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। তাঁদের সহযোগীতায় গবেষণায় অংশগ্রহণকারিদের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়। শিকরাই তাদেরকে কর্মশালায় অংশগ্রহণের জন্য নিশ্চিত করেন।

যে জিজ্ঞাসাগুলো নিয়ে কিশোরীদের কাছে যাওয়া

বা অংশগ্রহণমূলক কর্ম গবেষণার কর্মশালা করার জন্য স্কুলের একটি কাশরুমকে বেছে নেয়া হয়। এ ব্যাপারে প্রত্যেক স্কুলের প্রধান শিক সহ অন্যান্য শিকবৃন্দ যথেষ্ট সহযোগীতা করেন। কর্মশালা শুরুর আগে কিছু জিজ্ঞাসা সামনে তুলে ধরা হয়েছিলো। যেমন মেয়েদের বেলা ছিলোÑ


১. তোমাকে নিয়ে তুমি কী ভাবছ ?
২. বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ের বিষয়টি সম্মন্ধে তোমার কোনো ধারণা আছে কিনা বা তোমার জানতে আগ্রহ আছে কিনা ?
৩. মা বাবা ও পরিবারের অন্যান্যদের সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন ?
৪. এ সময় অন্যরা তোমাকে কি ভাবে দেখছে বলে তোমার মনে হয় ?
৫. তোমার মানসিক কোনো পরিবর্তন বা সমস্যা হচ্ছে বলে কি তোমার মনে হচ্ছে?
৬. তোমার কোনো শারীরিক সমস্যা কি আছে? থাকলে কি ?
৭. তোমার শারীরিক কোনো সমস্যা হলে অন্য কারো সঙ্গে কি আলাপ
আলোচনা করো ?
৮. মনের উপর কোনো চাপ বা প্রভাব পড়ছে কিনা ? পড়লে কেমন ?
৯. তুমি কোনো বৈষম্যের শিকার হচ্ছ কিনা?
১০.কি ধরণের বন্ধুদের সাথে তোমার বন্ধুত্ব রয়েছে
১১.যৌন নির্যাতনের শিকার কখনো হয়েছো কিনা? যদি হয়ে থাকো তাহলে মানসিক ভাবে তোমার কি পরিস্থিতি হয়েছে? পরিস্থিতি কি ভাবে অতিক্রম করেছো?
১২. ব্যাক্তিগত পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে তুমি কতটুকু সচেতন? তুমি কি ভাবে তোমার যতœ নাও?
১৩. প্রথম যখন ঋতুস্রাব হয়েছে তখন তোমার বয়স কত ছিলো? এ সময় পরিবারের কারো কাছ থেকে কোনো সহযোগীতা বা পরামর্শ পেয়েছো? পেলে কার কাছ থেকে ? কি রকম?
১৪. প্রথম যখন তোমার ঋতুস্রাব হয়েছে? তখন তোমার মনের অবস্থা কেমন হয়েছে? লজ্জায় কারো সাথে আলাপ না করে তুমি নিজে নিজে কি সমস্যার সমাধান করেছো? করলে কি ভাবে?
১৫. প্রতি মাসে ঋতুস্রাব না হয়ে ২/৩ মাস পরে হয় কিনা অর্থাত্ অনিয়মিত কিনা?
১৬. কোন অনুষ্ঠান উপলে ঋতুস্রাব বন্ধ রাখার জন্য অবিবাহিত অবস্থায় জন্মনিয়ন্ত্রন বড়ি ব্যাবহার কর কিনা?
১৭.ঋতুস্রাব হওয়ার আগে তোমার ব্যাগে প্রাথমিক ব্যাবস্থার জন্য প্যাড জাতীয় কিছু থাকে কিনা?
১৮. প্যান্টি ব্যাবহার কর কিনা?
১৯. অতিরিক্ত ঋতুস্রাব অথবা সাদা স্রাব হয় কিনা হলে মা/বোনের সাথে অলাপ কর কিনা ?
২০. তুমি কি মনে কর এ বিষয়টি সবার জানা দরকার?
২১. আরো কোনো বিষয় যদি থাকে, বল।


এছাড়াও জড়তা কাটিয়ে উঠার জন্য কিছু প্রাথমিক আলোচনা মস্তিষ্ক ঝড় ইত্যাদির মাধ্যমগুলো ব্যবহার করা হয়। যেহেতু বিষয়টি খুব সংবেদনশীল এবং কিছু ক্ষেত্রে একান্ত গোপনীয় বিধায় স্বাভাবিকতা আনতে যথেষ্ট কৌশলী হতে হয়েছে। প্রথম বিষয়টি নিয়ে তারা হতচকিত হয়ে পড়ে। একটু পরেই বিষয়টির গভীরে গেলে তারা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসে। তারা যখন বুঝতে পারলো বিষয়টি তাদের জন্য খুবই প্রয়েজনীয়, তখন এক পর্যায়ে তারা অনেকেই মন খুলে কথা বলতে থাকে। আমাদেরকেও সে পর্যন্ত অপো করতে হয়েছে। তাদেরকে সন্তর্পনে বলা হয়েছিলো, ‘কোনো রকম অস্পষ্টতা বা লজ্জায় নিজেকে চেপে না রেখে মন খুলে বল। মনে রাখবে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই সব নারী পুরুষ এ সময়টি পার করে। এ সময়টি প্রত্যেক নারী পুরুষের জন্য খুবই গুরুত্বপুর্ণ। তোমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা তোমার বয়সী অন্য বন্ধুদের জন্য অনেক ফলপ্রসু হবে। বিষয়টি ভয় বা লজ্জা পাওয়ার কোনো বিষয়ই নয়।’

কর্মশালার আলোচনা যেভাবে চলমান হলো-

এম,এ,সাত্তার উচ্চ বিদ্যালয়, ফতেপুর, নোয়াখালী পৌরসভা
২০ আগষ্ট,’০৮ সকাল এগারটায় বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্ব্যসেবা ও পরিচর্যা বিষয়ে এম. এ. ছাত্তার. উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে অংশগ্রহণ মূলক কর্মশালার প্রথম দিনের কার্যক্রম শুরু হয়।

স্কুল পরিচিতি
১৯৭৫ সনে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। স্কুলে রয়েছে সহশিা। বর্তমানে স্কুলে মোট ৩৯৮জন ছাত্র ছাত্রী রয়েছে। তার মধ্যে ছাত্রের সংখ্যা ১৪১জন এবং ছাত্রীর সংখ্যা ২৫৭জন। প্রধান শিক হিসাবে দায়িত্বে রয়েছেন জনাব আবুল কাশেম।

গবেষণার চলয়মানতা
আলোচনায় ১২ জন শিক্ষার্থী সহ এনিমেটর রাবেয়া সুলতানা নাজনীন এবং প্রধান গবেষক মাহমুদুল হক ফয়েজ অংশগ্রহণ করেন।
গবেষণার শুরুতে আমরা অংশগ্রহণ কারীদের সাথে পরিচিত হই। এরা সবাই প্রায় একই বয়সের। নানান আলোচনা দিয়ে শুরু হয় আলাপচারিতা। প্রথমেই নানান আন্তরিক কথাবর্তা, কৌতুক, মস্তিষ্কঝড় ইত্যাদির মাধ্যমে পরিচয়পর্ব শুরু হয়। সৃষ্টি হয় আলাপচারিতার জন্য এক সুন্দর সহায়ক পরিবেশ। তাদের সাথে কুশল বিনিময় এবং আলাপচারিতার এক পর্যায়ে তাদের মাঝ থেকেই আমাদের গবেষণার বিষয়বস্তু বয়ঃসন্ধিকাল শব্দটি উঠে আসে। তাই বয়ঃসন্ধিকাল কি? জানতে চাইলে ফারজানা(১৩) বলে, যে বয়সে আমাদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হয়ে থাকে, আমরা নিজেকে নিয়ে চিন্তিত থাকি বা নানা প্রশ্ন মনের মধ্যে জাগ্রত হয়। কিন্তু তা অন্য করো সাথে লজ্জায় আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করতে পারছিনা, সে বয়সকে বয়ঃসন্ধিকাল বলে।
কাউচার (১৬) বলে, বয়ঃসন্ধিকাল এ ছেলে মেয়েরা বড় হয়। শাহনাজ (১৬) বলে এ বয়সে ছেলে মেয়েদের অনেক পরিবর্তন হয়।
বয়ঃসন্ধিকালে তাদের কি কি পরিবর্তন হয়েছে এ বিষয়ে কাউচার বলে,বয়সের সাথে সাথে মনেরও পরিবর্তন হয়। এ বয়সে নিজেকে একা একা লাগে, পরিবারের কারো সাথে মিশতে বা কথা বলতে ভালো লাগে না। কাউচার মনে করে, এ বয়সে তার ছেলে বন্ধুর প্রয়োজন। যাকে সে তার মনের সব কথা খুলে বলতে পারবে। কিন্তু আগে তার এমন মনে হত না। সে বুঝতে পারছে বয়ঃসন্ধিকালে তার মনের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ছোটকালে তার আবেগ সুপ্ত ছিল কিন্তু এখন তা বিকশিত হয়েছে।
প্রমা পাল (১৪) বেশ মেধাবী চঞ্চল কাশের ’ফাষ্ট গার্ল’, কাশ কেপ্টেনও সে, হতাশার সুরে বলে, আগে খেলাধুলা করতে ভালো লাগত কিন্তু এখন ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আগের মত খেলতে পারিনা। এখন খেলাধুলা করতে বিবেকে বাধে। কারণ এখন বড় হয়েছি। চুপচাপ মেয়ে ফাতেমা মৃদুস্বরে বলে, আগে আমি কাউকে ভয় পেতাম না। সবাইকে ভীতু ডাকতাম। কিন্তু এখন আমার খুব ভয় লাগে। বিশেষ করে রাস্তা দিয়ে স্কুলে হেঁটে আসতে আর ঘরে রাতে একা পড়তে বসলে। তাছাড়া নারীদের প্রতি অত্যাচার দেখলে আমার আরও বেশি ভয় লাগে। তাই সব সময় নিজেকে খুব একা একা মনে হয়। মনে হয় আমি খুব অসহায়। কিন্তু আগে এমনটি মনে হত না।’
কখন মনে হয়েছিলো তুমি একটু বড় হয়েছো, অন্য মেয়েদের থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে গেছো। খেলতে খেলেতে সেই বিশেষ সময়টা তোমার এসেছিলো। আলোচনা চলতে চলতে লজ্জায় একে অপরের দিকে মুখ চাওয়া শুরু করলো, তারা বুঝতে পারলো বিষয়টি। অনাগত নারী হওয়ার এ যে ‘প্রথম কদম ফুল’। বিষ্ময়ে আবেগে নিজেকে নারীর মত অনুভব করা।

প্রথম ঋতুস্রাব যখন হয়েছিল তার এ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে লুত্ফুন্নাহার (১৬) জানায়, ১১ বছর বয়সে বাড়িতে প্রথম বারের মত ঋতুস্রাব হয়। সে আগে থেকে এ বিষয়ে কিছুই জানতনা তাই রক্ত দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ভেবেছে তাকে জোঁকে ধরেছে। এ সময় সে তার মাকে বলেছিল এবং তার মা তাকে সাহায্য করেছিল। কিন্তু কম বয়সে ঋতুস্রাব হয়ে যাওয়াতে তাকে অনেকে অনেক কথা বলেছে এমনকি তার মা চাচীরা পর্যন্ত গালমন্দ করেছে। একে একে বর্ণনা করছিলো তাদের তিক্ত মিষ্টি অভিজ্ঞতার কথা। কাউচার জানায়, ১৪ বছর বয়সে স্কুলে প্রথমবারের মত ঋতুস্রাব হয়, এ সময় সে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলো। লজ্জাও পেয়েছিলো। স্কুলের সহপাঠীরা তাকে সাহায্য করেছে।
তাসলিমার (১৬) প্রথম ১৩ বছর বয়সে ঋতুস্রাব হয়েছিল। তার মাকে বলেছে এবং মা তাকে সাহায্য করেছে। ফারজানা বলে, ১২ বছর বয়সে তার প্রথম ঋতুস্রাব হয়েছিল। তার বোন তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছিল। প্রথম ঋতুস্রাবের সময় লুৎফুন্নাহরের খুব ভয় লেগেছিল, ‘ভেবেছিলাম আমাকেও জোঁকে ধরেছে।’ ফাতেমা(১৫) বলে, ‘আমার খুব লজ্জা লেগেছিল আর নিজেকে খুব একা একা আর অসহায় মনে হয়েছিল’। নুরজাহান বলে, নিজেকে খুব অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল। প্রমা বলে এ সময় খুব ভয় আর অস্বস্থিকর লেগেছিল। শাহনাজ বলে, এসময় নিজেকে সবার কাছ থেকে আলাদা মনে হয়েছে। আর মনে হয়েছে আমি বড় হয়ে গেছি।
এসময় তোমার পরিবারের লোকজন বা অন্যরা তোমাকে কিভাবে দেখেছে? জানতে চাইলে লুত্ফুন্নাহার বলে, কম বয়সে ঋতুস্রাব হয়ে যাওয়াতে পরিবারের লোকজন সহ অন্যরাও অনেক বাজে কথা বলেছিল।
কাউচার বলে, এসময় মা বলেছে কারো সাথে না মেশার জন্য বিশেষ করে ছেলেদের সাথে। বলেছিলো সব সময় একা একা থাকতে।
ফারজানা বলে, এ বয়সে বাবা মা বা অন্যরা অনেক বেশী সন্দেহের চোখে দেখেন। কোন ছেলে এমনকি খালাতো, ফুফাতো, চাচাতো ভাইয়ের মত আপন কারো সাথে কথা বলতে দেখলে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করে। ভাবে প্রেমালাপ করছি। সবাই কেন জানি একটু অন্য চোখে দেখে। প্রমা বলেন, আগে খেলাধুলা করলে কেউ কিছু বলতনা কিন্তু এখন আমরা নাকি বড় হয়েছি তাই খেলাধুলা করলে বা দুষ্টুমি করলে বাবা মা এমনকি স্কুলের শিকরাও বকা দেয়। সবাই বলে, ‘তোরা এখন বড় হয়েছিস । তোরা এমন করলে ছোটরা কি করবে?’
প্রথম ঋতুস্রাবের সময় খাওয়া দাওয়ার প্রতি নানান নিষেধ থাকে। এ সময় মায়েরা আনেক কিছু খেতে দেয়না। এ বিষয়ে ফাতেমা বলে, মা বলেছে পানি কম খেতে। টক, ভাজা-পোড়া, শুটকি, মাছ - মাংস খেতে নিষেধ করেছেন। কাউচার আপে করে বলে, ‘প্রথম যেদিন ঋতুস্রাব হয় সেদিন মা শুধু আলু ভাজি দিয়ে ভাত খেতে দিয়েছিল। যদিও সেদিন আমাদের মাংস রান্না করেছিল। কিন্তু আমার খাওয়ার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মা খেতে দেয়নি’।
এ বয়সে কেউ কেউ শারীরিক সমস্যায় ভোগে। তখন কারো আথে আলাপ করে চিকিত্সা নিতে কুন্ঠা বোধ করে। কুসুম বলে, মাঝে মাঝে তার মাসে দুই বারও ঋতুস্রাব হয়। ওদের বাড়িতে বেদ বেদেনীরা আসে। তাদের কাছ থেকে সবাই টোটকা ঔষধ নেয়। সেও নিয়েছিলো। নুরজাহান বলে, কোন কোন মাসে তার দুই বার ঋতুস্রাব হয়। শুনেছে হুজুরের কাছ থেকে ফুঁ দিয়ে পড়ে আনা পানি কচু পাতায় করে খেলে ভাল হয়ে যাবে। তাই সে হুজুরের পড়া পানি খেয়েছিল। ডাক্তারের কাছে যেতে লজ্জ লাগে বলে যায়নি। কাউছার বলে, মাসে দুই বার ঋতুস্রাব হত। তখন হুজুরের পড়া পানি খেয়েছিল। এ সমস্যা তার এখনো আছে।
ফাতেমা বলে, ঋতুস্রাবের আগে ও ঋতুস্রাবের সময় প্রচন্ড পেট ব্যাথা, মাথা ব্যাথা ও কোমর ব্যাথা করে। কিন্তু কারো সাথে আলাপ করিনি।
নীরু বলেন, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া করে এবং যৌনাঙ্গ চুলকায়, কিন্তু কারো কোন পরামর্শ নেইনি। নীরু বিবাহিতা। বিয়ের পরে তার ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়ায় ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছিলো। ফারজানা বলে, প্রথম দুইবার ঋতুস্রাব হওয়ার পর প্রায় ৫ মাস বন্ধ ছিল। ‘তখন আমার বোনের সাথে আলাপ করেছিলাম । বলেছিল এটা এমনি হয়। আবার ঠিক হয়ে যাবে। তাই ডাক্তারের কাছে যাইনি। তাছাড়া ডাক্তারের কাছে গেলে অনেক টাকা লাগবে’। ঋতুস্রাব বা মাসিকের সময় কি ধরনের ব্যবস্থা নেয় জানতে চাইলে, সবাই বলে তারা কাপড় বা রুমাল ব্যবহার করে। তবে কোথাও বেড়াতে গেলে মাঝে মাঝে প্যাড ব্যবহার করে। এবং সবাই প্যান্টি ব্যবহার করে।
ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে তারা কতটুকু সচেতন? জানতে চাইলে, রূপালী বলে, ঋতুস্রাবের সময় আমি প্রতিদিন গোসল করি, আর পরিস্কার কাপড় পড়ি।
কাউচার বলে, ‘ঋতুস্রাবের সময় আমি প্রতিদিন দুইবার করে ব্যবহৃত কাপড় পরিস্কার করি’। আলোচনর সময় সবাই জানায়, এসময় তারা ডেটল ও ডিটারজেন্ট দিয়ে কাপড় পরিস্কার করে।
কি ধরনের মানুষের সাথে মিশতে বা বন্ধুত্ব করতে ভালো লাগে? জানতে চাইলে,
কাউচার বলে, যদিও মা নিষেধ করেছেন ছেলেদের সাথে না মিশতে কিনতু ছেলেদের সাথে মিশতে আমার বেশী ভালো লাগে। শাহনাজ বলে একটা মেয়ে বন্ধুর চেয়ে ছেলে বন্ধু অনেক বেশী সাহায্য করে। তাই ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব করতে ভালো লাগে। প্রমা বলে, চুম্বক যেহেতু বিপরীত ধর্মের প্রতি আকর্ষণ করে, তাই এ বয়সে মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের প্রতি আকর্ষণ থাকায় ছেলেদের সাথে মিশতে বেশী ভালো লাগে।
ফারজানা বলে, এ বয়সে যাকে দেখি তাকেই ভালো লাগে। তাকে জানতে ইচ্ছে করে এবং তার সাথে মিশতে এবং বন্ধুত্ব করতে ইচ্ছে করে।

মা বাবা ও পরিবারের অন্যান্যদের সাথে আনেকেরই সম্পর্ক খুব গভীর নয়। তাসলিমা বলে, বাবা মায়ের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নেই। বাবা বিদেশ থাকেন তাই মেশার সুযোগ কম পাই।
রূপালী, নীপু দুই বোন জানায়, বাবা খুব রাগী তাই বাবাকে খুব ভয় পায়। কিন্তু মায়ের সাথে তাদের সখ্যতা।
ফারজানা বলে, মায়ের সাথে সম্পর্ক ভালো কিন্তু বাবাকে ভয় পায়।
শাহনাজের বাবা নেই। তার তিন বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। বাবার কথা খুব একটা মনে নেই তার। শাহনাজ জানায়, ‘তিন বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ায় বাবাকে কাছে পাইনি কিন্তু মায়ের সাথে সম্পর্ক ভালো’।
তারা কি কোন ভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে কিনা? জানতে চাইলে
শাহনাজ বলে, আমরা বড় হয়েছি তাই ভালো খাবার ছোট ভাইকে খেতে দেয়া হয়। বাড়িতে মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের কদর বেশী।
কখনো কোন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে কিনা? জানতে চাইলে
শাহনাজ বলে, মেলায় গেলে এ ধরনের সমস্যা হয়।
কাউচার বলে, একবার বিয়ে বাড়িতে এ ধরনের সমস্যা হয়েছিলো।
ফারজানা বলে, একবার স্যারের বাসায় প্রাইভেট পড়ার সময় স্যার আমার পায়ের উপর পা রাখে। আমি সরানোর চেষ্টা করলে স্যার খুব জোরে পা দিয়ে চেপে ধরে রেখেছিল। সেদিনের পর থেকে আমি আর প্রাইভেট পড়তে যায়নি। আর তখন আমার খুব কষ্ট লেগেছিল। এ বয়সে অনেকেই নিজেকে গিন্নি গিন্নি ভাবে। গ্রামে অনেকেরই এ বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। তাদের এক সহপাঠিনীরও বিয়ে হয়েছে। বিয়ে কি? জানতে চাইলে অনেকে বলে, বিয়ে মানে ঝামেলা, কারণ বিয়ের পর মেয়েদের কোন স্বাধীনতা থাকেনা, পরিবারের সব দায়িত্ব মেয়েদের উপর এসে পড়ে। আর একটা অপরিচিত মানুষ কিভাবে এত আপন হয়। এটা তারা ভেবে পায়না। বিয়ের জন্য কি নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়? জানতে চাইলে সবাই বলে, বিয়ের জন্য শারীরিক ও মানষিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। এটা তারা বুঝে।
বয়ঃসন্ধিকালটি সব মেয়ের জীবনে আসে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কিছু জানার সুযোগ নেই। এ বিষয়টি সম্পর্কে সবার জানা দরকার। ‘আমরা এ বিষয়ে আরও বেশি জানতে চাই। আমাদের পাঠ্য বইতে এ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করলে এবং শিকেরা এ বিষয়ে আমাদের কাশ নিলে আমরা আরও বেশি জানার সুযোগ পেতাম।’ এক বাক্যে সবাই সায় দেয়।
তাদের সাথে ৩ ঘন্টা আলোচনা করার পর দুপুর ২.০০ টায় প্রথম দিনের মত কার্যক্রম শেষ হয়।



২য় ও ৩য় দিনের কর্মশালা
এম. এ. ছাত্তার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিার্থীদের সাথে বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্যসেবা ও পরিচর্যাা বিষয়ে ২৭ শে আগষ্ট অংশগ্রহণমূলক কর্মশালার দ্বিতীয় দিনের কার্যক্রম শুরু হয়।
শুরুতেই আমরা সবাই সবার কুশল বিনিময় করি। এবং তাদের কাছে জানতে চাই প্রথম দিনের অংশগ্রহণমূলক কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে কেমন লাগছে? জানতে চাইলে কাউচার বলে, ‘এ কর্মশালায় অংশগ্রহণ করতে পেরে আমার খুব ভালো লেগেছে, আমার সহপাঠীদের সাথে যেসব কথা আগে বলতে পারিনি এ কর্মশালায় এসে তা বলতে পেরেছি।এ কর্মশালায় বিভিন্ন সমস্যা আলোচিত হয় যাতে আমি অনেক উপকৃত হয়েছি। ’
প্রমা বলে, ‘এ কর্মশালায় এসে মনের না বলা কথা গুলো বলতে পারায় খুব ভালো লেগেছে। যেসব সমস্যার কথা সহপাঠীরা আগে কখনো বলেনি কিন্তু কর্মশালায় সবাই নিঃসঙ্কোচে একান্ত কিছু কথা বলেছে আমাকে ভাবিয়েছে। আমার নতুন অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে।’
ফারজানা বলে, ‘এ কর্মশালায় আমরা যেসব বিষয়ে আলোচনা করেছি যা আমি আমার ভবিষ্যতে কাজে লাগাতে পারব। নুরজাহান বলে, আমি যে কত কিছু জানি না তা এ কর্মশালায় এসে বুঝতে পেরেছি। আর এখন উপলব্ধি করতে পারছি আমার এখনও অনেক কিছু জানার বাকী আছে।’
বিবি ফাতেমা বলে, ‘এ কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে যা কিছু সবার আলোচনা থেকে উঠে এসেছে এসব বিষয় আগে থেকে জানলে আমরা অনেক উপকৃত হতাম, তাই আমাদের পাঠ্য বইতে এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকলে অনেক ভালো হত।’
স্কুলে হঠাত্ করে ঋতুস্রাব হলে কোন ব্যবস্থা আছে নাকি? জানতে চাইলে সবাই বলে স্কুলে এই ধরনের কোন ব্যবস্থা নেই তবে থাকলে অনেক ভালো হত। কারণ স্কুলে অপ্রস্তুত অবস্থায় ঋতুস্রাব হয়ে গেলে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। কাশ না করে ছুটি নিয়ে বাড়িতে চলে যেতে হয়।
মাসিক বা ঋতুস্রাবের সময় ব্যবহৃত রুমাল বা কাপড় কোথায় শুকাতে দেয়? জানতে চাইলে বলে, কেউ ওড়নার নিচে, ঘরে আলনার পেছনে আবার কেউ বেড়ার উপর শুকাতে দেয়। শারীরিক কোন সমস্যা বিশেষ ঋতুস্রাবে কোন সমস্যা হলে তারা কি করে? জানতে চাইলে ফাতেমা বলে, ‘আমার ঋতুস্রাব এবং সাদা স্রাব বেশি হয়। শুনেছি কলাকচুর পাতার রস ও আদামনির রস খেলে কোমর ব্যাথা ও সাদা স্রাব কমে যায়’। কাউচার বলে, তার বোনের শারীরিক সমস্যা হওয়ায় তিনি পুকুরে গলা পর্যন্ত পানিতে নেমে ঔষধী গাছের রস খেয়েছিলো। শারীরিক কোন সমস্যা বা অন্য কোন সমস্যা হলে গ্রাম্য কোন চিকিত্সা নিয়েছে কিনা? জানতে চাইলে কুসুম বলে, আমাদের গ্রামে প্রায় সময় বেদেরা আসে আর কিশোরীদের দেখে বলে, ‘তোমাদের মাসিক কি আগে হয়? মাসিকের সময় পেট ব্যাথা করে, মুখ কালো হয়ে থাকে? তাহলে তাবিজ ব্যবহার করলে এসব ভালো হয়ে যাবে, তাদের বলা কথা গুলো সত্যি বলে সবাই বিশ্বাস করে আর ১০০/১৫০ টাকা করে এসব তাবিজ কিনে নেয়।’
নুরজাহান বলে, ‘পুরুষ ডাক্তার বলে কোন সমস্যা হলে ডাক্তারের কাছে যাইনা। কারণ ডাক্তারের কাছে খোলাখুলি ভাবে সব বলতে লজ্জা লাগে। তাই হুজুরের পানি পড়া খাই’। ঋতুস্রাবের সময় তারা কে কি নিয়ম মেনে চলে? জানতে চাইলে কাউচার বলে, ‘এ রকমের মেয়েরা এ সময় গরু জবাই করতে দেখেনা। কারণ এই বিশ্বাসে যে, গরু জবাই করতে দেখলে ঋতুস্রাবের সময় জবাই করা গরুর রক্তের মত বের হবে।’
ফাতেমা বলে, এসময় রাস্তায় যেতে সবাই নিষেধ করে। তবে গেলেও সাথে করে কয়লা আর রসুন সাথে রাখতে হয়। তাছলিমা বলে, এসময় সুগন্ধি জাতীয় কোন কিছু যেমন - তেল, স্নো, পাউডার এগুলো ব্যবহার করিনা।
কুসুম বলে, ‘ঋতুস্রাবের সময় চুল খোলা রাখা যায় না।’
লুত্ফুন্নাহার বলে, ‘ঋতুস্রাবের সময় কবরস্থান এবং চিতা খোলার সামনে দিয়ে হাঁটা যায়না।’
আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করার পর বিকেল চারটায় দ্বিতীয় দিনের কার্যক্রম শেষ হয়।



তৃতীয় দিনের কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের মাঝে আরো শত:স্ফুর্ততা ল্য করা গেছে। এসময় এরা আরো আন্তরিকতা নিয়ে নানান কথা বলে। তারা জানায়, এ সময় কোন রকম শাসন এদেরকে আরো একরোখা ও ক্ষুব্ধ করে তুলে। পরিবারের কেউ শাসন করলে কেমন লাগে? আর তখন কি করতে ইচ্ছে করে? জানতে চাইলে সবাই বলে, বকাবকি করলে, আর মারধর করলে খুব খারাপ লাগে, তখন মনে হয় আমাদের আপন কেউ নেই, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ঘর থেকে বের হয়ে যাই।
কাউছার বলে, ভাইয়ের সাথে ঝগড়া হলে, মা মারধর করলে মাঝে মাঝে বিষ খেতে ইচ্ছে করে। লুৎফুন্নাহার বলে, মায়ের সাথে রাগ করে আমি মাঝে মাঝে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিই। একবার একাধারে তিনদিন উপোস ছিলাম। বীথি বলে, দাদু মাকে নিয়ে বকাবকি করলে মা আমাকে মারেন। আমাকে মেরে মা আবার আড়ালে গিয়ে কাঁদেন।
ফাতেমা জানায়, আমার ভাইয়ের দোষ হলেও মা আমাকেই বেশি মারেন।
ওরা বলে, জয়কৃষ্ণপুরে অনেক আগে মা মারধর করায় ট্রেনের নীচে আত্মহত্যা করেছিলো একটি মেয়ে।
কিন্তু ওরা একমত হয় যে, আত্মহত্যা কোন সমস্যার সমাধান নয়। বরং এতে সমস্যা আরও বাড়ে।
আলোচনায় ওরা বলে, নিজেদের মত করে কাজ করতে আমাদের ভালো লাগে। কেউ কিছু জোর করে চাপিয়ে দিলে খুব খারাপ লাগে । বাবা-মা মারধর করলে নিজেকে খুব অসহায় লাগে। কিন্তু বাবা-মা না মেরে বুঝিয়ে কললে ও আমরা তাদের কথা শুনি। তারা জানায়, স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য স্কুল হেল্থ কিনিকের কথা তারা জানেনা। এর অবস্থান কোথায় তারা জানেনা। আলোচনায় তারা স্কুল হেলথ কিনিক থেকে স্বাস্থ্যসেবা নেয়ার ইচ্ছা পোষন করে। এর মধ্য দিয়ে ৩য় দিনের ও এপর্বের শেষ কার্যক্রম সমাপ্ত হয়



হাসান হাট হাই স্কুল, ১৫ নং শরিফপুর ইউনিয়ন, বেগমগঞ্জ উপজেলা, নোয়াখালী

বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্যসেবা ও পরিচর্যা বিষয়ে অংশগ্রহণমূলক কর্মশালা কার্যক্রম ২৬ শে আগস্ট হাসান হাট উচ্চ বিদ্যালয়ে সকাল এগারটায় প্রথম দিনের মত শুরু হয়। পূর্বের স্কুলের কর্মশালার মত আলোচনার শুরুতে আমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হই এবং তাদের সাথে কুশল বিনিময় করি।

স্কুল পরিচিতি
হাসান হাট হাই স্কুল নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার ১৫ নং শরিফপুর ইউনিয়নে হাসান হাটে অবস্থিত। স্কুলে রয়েছে সহশিা। স্কুলের ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা ৭০১জন। ছাত্র সংখ্যা ৩০২জন এবং ছাত্রী সংখ্যা ৩৯৯জন। স্কুলটির পাশে দিয়ে চলে গেছে একটি সরু পাকা রাস্তা এবং তর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নোয়াখালী খাল। স্কুলের প্রধান শিকের দায়িত্বে রয়েছেন জনাব মোশাররফ হোসেন। স্কুলটি ১৯৬৮ সনে প্রতিষ্ঠিত হয়।


গবেষণার চলয়মানতা
এখানেও এম,এ,সাত্তার স্কুলের কর্মশালার মত জিজ্ঞাসাগুলো আমাদের সামনে ছিলো। আলোচনার এক পর্যায়ে গবেষণা কি? জানতে চাইলে তারা বলে বিজ্ঞানীরাই গবেষণা করে।
গবেষণা মানে আলোচনা করা, কোন কিছুকে বিশ্লেষণ করা।
গবেষণা মানে অনেকে মিলে বসে কথা বলা।
গবেষণা মানে খোঁজাখুঁজি করা।
তারা খেলাধুলা করে কিনা? জানতে চাইলে আয়েশা (১৭) বলে, গ্রামাঞ্চলে এ বয়সে খেললে সবাই বিভিন্ন ধরনের বাজে কথা বলে।
রোজিনা (১৬) বলে, এ বয়সে খেলা ভালো না। তাই শরীরের জন্য ভালো হলেও বাবা মা খেলতে দেয় না।
মুন্নি (১৫) বলে, এখন বড় হয়েছি বলে খেললে গ্রামের লোকজন অনেক খারাপ কথা বলে। এখানে বিভিন্ন ধরনে কুসংস্কার রয়েছে। যা সবাই বিশ্বাস করে। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও খেলাধুলা করিনা। তাছাড়া এখন আমরা বড় হয়ে গেছি।
কিভাবে বুঝতে পেরেছে তারা বড় হয়েছে? জানতে চাইলে সবাই বলে এ বয়সে আমাদের শারীরিক অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আর শারীরিক পরিবর্তন থেকে মানসিক পরিবর্তন হয়েছে। তাই আমরা বুঝতে পেরেছি আমরা বড় হয়েছি।
কোন সময় থেকে তোমরা বড় হয়েছো? জানতে চাইলে পপি বলে, যখন প্রথমবারের মত ঋতুস্রাব হয়েছিল তখন থেকে আমি বুঝি আমি বড় হয়েছি।
প্রথম কখন ঋতুস্রাব হয়েছে? জানতে চাইলে বিবি আয়েশা (১৭) বলে, প্রথম ১২ বছর বয়সে তার ঋতুস্রাব হয়েছিল।
পপির জানায়, ১৩ বছর বয়সে তার প্রথম ঋতুস্রাব হয়।
মুন্নী জানায় প্রথম যখন তার ঋতুস্রাব হয় তখন তার বয়স হয়েছিলো ১৪ বছর। সে সময় সে খুব অস্বস্থিতে ভুগেছিলো।
প্রথম ঋতুস্রাবের সময় তাদের কেমন লেগেছিল? তখন কার সহযোগিতা নিয়েছিল? আগে থেকে এ সম্পর্কে ধারণা ছিল কিনা? জানতে চাইলে আয়েশা বলে, প্রথম ঋতুস্রাবের সময় আমার খুব ভয় লেগেছিল। আগে থেকেও এ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। লজ্জায় কাউকে কিছু বলতে পারিনি। বুদ্ধি করে নিজের মত করে ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। পরে আমার বান্ধবীকে বলেছিলাম। সে আমাকে বলেছে কি কি করতে হবে।
পপি বলে, ‘আগে থেকে কিছুই জানতাম না। প্রথম যেদিন আমার ঋতুস্রাব হয়েছিল সেদিন দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত কিছুই বুঝতে পারিনি। পরে আমার আপু দেখে বুঝতে পেরেছে এবং আমাকে সাহায্য করেছে’।
রোজিনা বলে, প্রথম ঋতুস্রাবের সময় আমি খুব ভয় পেয়ে কান্না করেছিলাম। তখন আমার মা আমাকে সাহায্য করেছে।
তোমরা কি কারো কাছে এসব বিষয়ে জানতে চেয়েছো? জানতে চাইলে
তমা বলে, বড়রা এ বিষয়ে বলতে লজ্জা বোধ করে। আর আমরাও কিছু জানার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করতে লজ্জা বোধ করি।
আয়েশা বলে, বড়দের কাছ থেকে এসব বিষয়ে কিছু জানতে চাইলে তারা আমাদের খারাপ মনে করে।
মুন্নি বলে, অনেক কিছু জানার আগ্রহ থাকলেও ভয়ে কারো সাথে আলাপ করতে পারিনা।
এসময় তারা কি ব্যবহার করে? জানতে চাইলে বলে কেউ কেউ স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করলেও সবাই রুমাল ব্যবহার করে।
এসময় তাদের ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে কি করে? জানতে চাইলে বলে,
এসময় সবাই ডিটারজেন্ট বা সাবান দিয়ে ব্যবহৃত রুমাল পরিস্কার করে।
এবং এসময় তারা গরম পানি ও ডেটল ও ব্যবহার করে। কেউ কখনো বৈষম্যের শিকার হয়েছে কিনা? জানতে চাইলে ফেরদৌসী বলে, ‘মা ছেলেদের বেশী আদর করে, তাদের বেশী খেতে দেয়। পরিবারে ভালো কিছু রান্না করলে ভাইকে বেশি খেতে দেয়।’
এ বয়সে এসে মনের উপর কি ধরনের ্প্রভাব পড়েছে? জানতে চাইল আয়েশা বলে
এ বয়সে ইচ্ছে করে কারো সাথে মিশতে , বন্ধুত্ব করতে মনের কথা গুলি বলতে কিন্তু ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তা পারিনা।
মুন্নী বলে ‘আমি যখন সপ্তম শ্রেণীতে উঠার পর তখন আমার এক সহপাঠী আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। তখন তাকে কিছু না বললেও অষ্ঠম শ্রেণীতে তার সাথে আমার সম্পর্ক হয়। এ সম্পর্কের কথা জানাজানি হয়ে গেলে স্কুলের শিকেরা আমার অভিভাবককে এ ব্যাপারে জানায়। যা আমার মনের উপর অনেক বেশি প্রভাব ফেলেছে।’
দুপুর ১.০০টায় তাদের সাথে আলোচনা শেষ করে আমরা প্রথম দিনের মত কার্যক্রম শেষ করি।

২য় ও ৩য় দিনের কর্মশালা
হাসন হাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ২য় ও ৩য় কার্যক্রমের আলোচনায় এই কর্মশালা সম্পর্কে সবার অভিমত জানতে চাইলে লিপি বলে, ‘বাড়িতে মার সাথে কর্মশালার কথা বলেছি, মা বলেছে এসব নিয়ে আলোচনা করা ভালোনা’।
কিন্তু লিপি মনে করে এ বিষয়গুলো জানা দরকার। মুন্নি বলে, ‘কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে এমন অনেক বিষয় জেনেছি যা স্কুলের শিকরা কখনো আলোচনা করেনা।
এ বয়সে তাদের মানসিক অবস্থা বাবা মায়ের মধ্যে কে বোঝে? জানতে চাইলে তারাবলে, ১৪ জন শিার্থীর ১২ জনের বাবাই প্রবাসী তাই মাই বুঝে বাবা বোঝেনা। বুঝতে চায়ও না। ছুটির দিনে কোথাও বেড়াতে যায় কি? জানতে চাইলে সবাই বলে, মাঝে মাঝে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে যাই। কিন্তু দূরে কোথাও যেতে চাইলেও কখনো যেতে পারিনি।

আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। লীণারায়ণ পুর, সদর, নোয়াখালী
২৮ শে আগস্ট আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্য সেবা ও পরিচর্যা বিষয়ক অংশগ্রহণ মূলক কর্মশালার প্রথম দিনের কার্যক্রম শুরু হয়।
স্কুল পরিচিতি
আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় নোয়াখালী সদর উপজেলার কাদির হানিফ ইউনিয়নের লীণারায়ন পুর গ্রামে অবস্থিত। স্কুলে রয়েছে সহশিা। বর্তমানে স্কুলে মোট ৩৮৭ জন ছাত্র ছাত্রী রয়েছে। তার মধ্যে ছাত্রের সংখ্যা ১৮০ এবং ছাত্রীর সংখ্যা ২০৭জন। প্রধান শিক হিসাবে দায়িত্বে রয়েছেন বাবু ভক্তি রঞ্জন ঘোষ।

যে জিজ্ঞাসাগুলো নিয়ে কিশোরদের কাছে যাওয়া
ছেলে ও মেয়ে একই বয়স আতিক্রম করলেও তাদের ধরণ হয় সম্পূর্ণ আলাদা। মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা বহির্মুখী হওয়াতে তারা এ সময় নানান ধরনের সঙ্গ পায়। ছেলেদের সাথে বয়ঃসন্ধিকালীন বিষয় আলোচনার আগে তারা ছিলো সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত। মস্তিষ্ক ঝড় সহ নানান আলোচনায় তারা স্বাভাবিকতায় ফিরে আসে। এক সময় তারা সবাই খুব খোলামেলা আলোচনা করতে থাকে। অংশগ্রহণমূলক কর্ম গবেষণায় যে জিজ্ঞাসা গুলো আমাদের সামনে ছিলো, ভাব আদান প্রদানের মাধ্যমে যানতে চাওয়া হয়েছিলো-

১.তোমাকে নিয়ে তুমি কী ভাবছ ?
২.বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ের বিষয়টি সম্মন্ধে তোমার কোনো ধারণা আছে কিনা বা তোমার জানতে আগ্রহ আছে কিনা ?
৩.মা বাবা ও পরিবারের অন্যান্যদের সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন? তারা কি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারে বলে তোমার মনে হয়?
৪.এ সময় অন্যরা তোমাকে কি ভাবে দেখছে বলে তোমার মনে হয়? পরিবারের অন্যেরা তোমাকে কি সমিহ করে?
৫.তোমার মানসিক কোনো পরিবর্তন বা সমস্যা হচ্ছে বলে কি তোমার মনে হচ্ছে?
৬.তোমার কোনো শারীরিক সমস্যা কি আছে? থাকলে কি ?
৭.তোমার শারীরিক কোনো সমস্যা হলে অন্য কারো সঙ্গে কি আলাপ আলোচনা করো ?
৮.মনের উপর কোনো চাপ বা প্রভাব পড়ছে কিনা ? পড়লে কেমন ?
৯.তুমি কোনো বৈষম্যের শিকার হচ্ছ কিনা?
১০.কি ধরণের বন্ধুদের সাথে তোমার বন্ধুত্ব রয়েছে? তোমার অবিভাবকরা তোমার বন্ধু বান্ধবদের চেনে?
১১.প্রথম যখন তোমার গলারস্বর পরির্তন ল করেছো তখন কি তুমি লজ্জা পেয়েছিলে?
১২.যখন তোমার প্রথম মোচ দাড়ি উঠছিলো তখন তোমার অনুভুতি কেমন ছিলো?
১৩.অপরিচিত কোনো মেয়ে বা নারিদের সাথে কথা বলতে তুমি লজ্জা বোধ কর?
১৪.মা, বোন অথবা ঘনিষ্ট জনদের সাথে অন্যদের কিভাবে তুলনা কর বা দেখ?
১৫.যৌন নির্যাতনের শিকার কখনো হয়েছো কিনা? যদি হয়ে থাকো তাহলে মানসিক ভাবে তোমার কি পরিস্থিতি হয়েছে? পরিস্থিতি কি ভাবে অতিক্রম করেছো?
১৬. ব্যাক্তিগত পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে তুমি কতটুকু সচেতন? তুমি কি ভাবে তোমার যতœ নাও?
১৭.তুমি কি তোমাকে সুন্দর ও আকর্শনীয় করে রাখতে চাও? কেন?
১৮.তুমি কি ধুম পান কর?
১৯.তোমার কি স্বপ্নদোষ হয়? কখন তোমার প্রথম হয়েছে? তখন কি করেছো?
২০.তুমি কি হস্তমৈথুন কর? নিয়মিত?
২১. তোমার ছোট খাট সাফল্যে কেউ কি তোমাকে খুব প্রসংশা করে? উত্সাহ দেয়?
২২.তুমি কি চাও সব কাজে তোমাকে সবাই প্রসংশা করুক, উত্সাহিত করুক?
২৩ তুমি কি মনে কর বয়ঃসন্ধি কালের বিষয়টি সবার জানা দরকার?
২৪. আরো কোনো বিষয় যদি থাকে, বল।

আলোচনায় আমরা তাদের মনে করিয়ে দেই, ‘কোনো রকম অস্পষ্টতা বা লজ্জায় নিজেকে চেপে না রেখে মন খুলে বল। এ সময়টাতে ছেলেদের অনেক কিছু দৃশ্যমান হয়। কিন্তু আরো অনেক কিছু আছে যা দৃশ্যমান নয়। যদিও এগুলো একেবারে ব্যক্তিগত বিষয় তবুও প্রত্যেকের এগুলো জানা অনেক জরুরী’। আমরা তাদের মনে রাখতে বলেছি, ‘প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই সব নারী পুরুষ এ সময়টি পার করে। এ সময়টি প্রত্যেক নারী পুরুষের জন্য খুবই গুরুত্বপুর্ণ। তোমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা তোমার বয়সী অন্য বন্ধুদের জন্য অনেক ফলপ্রসু হবে। বিষয়টি ভয় বা লজ্জা পাওয়ার কোনো বিষয়ই নয়।’

গবেষণার চলয়মানতা
আলোচনার শুরুতে আমরা সবার সাথে পরিচিত হই এবং সবার সাথে কুশল বিনিময় করি।
প্রথমে তাদের কাছে জানতে চাই গবেষণা কি? ওরা বলে গবেষণা মানে নতুন কিছু আবিষ্কার করা । গবেষণা মানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা।
তাদের এ বয়সকে কি বলে? জানতে চাইলে নোমান (১৬) বলে, এ বয়সকে কিশোর বলে। হাসান (১৭) বলে, এ বয়সকে বালাই বলে। কেন বালাই বলে?
হাসান বলে, এ বয়সে কিছু ভালো লাগেনা আবেগ বেড়ে যায়, সারণ দুষ্টুমি করতে ভালো লাগে, কারণ এখন হচ্ছে বয়ঃসন্ধিকাল।
এটা বয়ঃসন্ধিকাল কিভাবে বুঝলে? জানতে চাইলে তারা বলে, এ বয়সে শারীরিক গঠনের পরিবর্তন হয়েছে, কন্ঠস্বরের পরিবর্তন হয়েছে। আগে দ্রুত কথা বলতে পারতাম না কিন্তু এখন পারি, পড়ালেখা করতে ইচ্ছে করেনা। আড্ডা দিতে ইচ্ছে করে।
কখন থেকে তোমাদের এ পরিবর্তন শুরু হয়েছে? জানতে চাইলে মামুন (১৬) বলে, অষ্টম শ্রেণীতে উঠার পর মনে হয়েছে আমার বিবেক বুদ্ধি হয়েছে।
নোমান (১৬) ১৪ বছর বয়স থেকে আমার দাড়ি - গোঁফ গজাতে শুরু করে।
প্রথম যখন দাড়ি-গোঁফ উঠেছে তখন তোমার কেমন লেগেছিল ? জানতে চাইলে নিজাম (১৬) বলে, প্রথম যখন দাড়ি - গোঁফ উঠেছে তখন খুব লজ্জা লেগেছিল। আর ভয় ও লেগেছিল কারন মা বলেছিল দশম শ্রেণীতে উঠার আগে যেন শেভ না করি।
সাজ্জাদ বলে এসময় সবার সামনে যেতে অস্বস্থিকর লাগে।
এ বয়সে কি করতে বেশী ভালো লাগে? জানতে চাইলে হাসান বলে, এ বয়সে বার বার চুল আঁচড়াতে ,স্মার্ট হয়ে মেয়েদের সামনে যেতে, আর বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে।
মাদকের প্রতি কার ও আসক্তি আছে কিনা? জানতে চাইলে হাসান বলে এ বয়সে মাদকের প্রতি ছেলেদের বেশি আকর্ষণ থাকে। অনেকে এ বয়সে এসে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। হাসানের এক বন্ধুর প্ররোচনায় পড়ে সিগারেট খেয়েছিল। কিন্তু প্রথম দিনে সিগারেট খাওয়ার অভিজ্ঞতা খারাপ ছিল। তাই সে উল্টা তার বন্ধুকে সিগারেট খেতে নিষেধ করেছিল।
আকরাম জানায়, তার বন্ধু ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় মা মারা যাওয়ার পর সঠিক গাইডের অভাবে মাদকের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। এরপর সে চুরি করা শুরু করে এবং বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জডিয়ে পড়ে , এমনকি এখন তার কাছে অস্ত্রও রয়েছে। নিজাম বলে তার বন্ধু মাহবুবুর রহমান নবম শ্রেণীতে উঠার পর নেশাগ্রস্থ হয়ে যায়। এক সময় সে তার বাবা মায়ের আয়ত্বের বাইরে চলে যায়। পরে সে পড়ালেখা ছেড়ে ঢাকায় চলে যায়। ও যা চাইত বাবা মা ওকে তাই দিত।
সবাই বলে, এ বয়সে বেপথে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
আক্কেল দাঁত উঠেছে কিনা? জানতে চাইলে আকরাম বলে, তার আক্কেল দাঁত উঠেছে, দাঁত উঠার সময় খুব ব্যাথা করে ছিল। পরে তার আব্বু তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার বলেছে আক্কেল দাঁত উঠছে। তাই ব্যাথা করছে।
রোকন বলে, তার আক্কেল দাঁত উঠেছে। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল।
কারও স্বপ্নদোষ হয় কিনা? হলে কেমন লাগে? জানতে চাইলে আকরাম বলে,তার স্বপ্ন দোষ হয়। বিশেষ করে রাতে খারাপ কিছু চিন্তুা করে ঘুমালে। সে আরও বলে, স্বপ্নদোষ হওয়ার পর শরীর ব্যাথা করে, শরীর অবশ লাগে।
কিন্তু প্রথমে যে এ ব্যাপারে কারও সাথে আলাপ করেনি। হঠাত্ একদিন তার নাভীর নিচে ব্যাথা অনুভূত হওয়ায় বাবা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। ডাক্তার জিজ্ঞেস করেছিল স্বপ্নদোষ হয় কিনা? কিন্তু সে লজ্জায় কিছুই বলতে পারেনি।
শাহাদাত্ বলে, বেদেরা স্বপ্নদোষ না হওয়ার জন্য তাবিজ বিক্রি করে।
কারও কোন কু-অভ্যাস আছে নাকি? এখন তারা কি করে? জানতে চাইলে ওয়াসিম বলে, ‘যৌন উত্তেজনা বেড়ে গেলে সাবান দিয়ে হস্ত মৈথুন করি।’
সুমন আর সাজ্জাদ বলেছে তারাও এমনটি করে। তারা কিভাবে এসব জেনেছে? জানতে চাইলে তারা জানায়, বাজারে বিভিন্ন ধরনের ম্যাগাজিন বই ও পর্নো বই বিক্রি করে। যা পড়ে তারা এ সম্পর্কে জানতে পেরেছে।
কেউ তাদের বন্ধুদের সাথে সমকামিতায় লিপ্ত হয় কিনা? জানতে চাইলে
ওয়াসিম বলে ও তার বন্ধুদের সাথ যৌন কাজ করে।
এ বয়সে কি ধরনের ছবি দেখতে ভালো লাগে? জানতে চাইলে সবাই বলে তাদের রোমান্টিক ছবি দেখতে বেশি ভালো লাগে। বিশেষ করে ‘লাভ স্টোরী’ আর নাচ- গান যা দেখলে মন চঞ্চল হয়ে উঠে। বাবা মায়ের সাথে সম্পর্ক কেমন? জানতে চাইলে শাহাদাৎ বলে, বাবা খুব রাগী । কোন কথা বুঝতে চায়না। বয়ঃসন্ধিকালের মানসিক সমস্যাটা, কষ্টটা বাবা মা বোঝেনা। মনে হয় তাদের সময় এমন ছিলনা।
কোন ব্যাপারগুলো তাদের খুব কষ্ট দেয়? জানতে চাইলে তারা বলে, ‘বাড়িতে সবাই কেমন যেন অন্য ভাবে দেখে। সবাই শুধু অবজ্ঞা করে। এমনকি অফিস আদালতে অবহেলা করা হয়। শিকেরা বিভিন্ন ধরনের অপমানমূলক কথা বলে। সময়বয়সী মেয়েরা থাকলে কোন আতœীয়ের বাড়িতে গেলে সন্দেহের চোখে দেখে। এসব ব্যাপার আমাদের আত্মসম্মানে লাগে। কেউ আমাদের সাথে রাগারাগি না করে বুঝিয়ে বললে বেশি ভালো লাগে। আমরা চাই সবার আদর আর একটু সম্মান। চাইনা কোন প্রকার বৈষম্য।’
এভাবেই আলোচনার পর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মশালার ১ম দিনের কার্যক্রম শেষ হয়।



২য় ও ৩য় দিনের কর্মশালা
আদর্শ স্কুলে ২য় ও ৩য় দিনের গবেষণায় ছেলেরা আরো খোলা মেলা আলোচনায় অংশগ্রহণ করে।
গবেষণার শুরুতে আমরা অংশগ্রহণ কারীদের সাথে কুশল বিনিময় করি।
তারপর আমরা অংশগ্রহণকারী দের ১ম দিনের কর্মশালা সম্পর্কে জানতে চাইলে।
নিজাম বলে, এ কর্মশালায় এসে আমি মনের ভেতরকার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছি। নোমান বলে, আমরা আগের ধারণা, অনুভূতি গুলো ছিল একরকম। এখন একটু হলেও পাল্টে গেছে। হাসান বলে, এ কর্মশালায় এসে অজানা অনেককিছু জানতে পেরেছি। আর বুঝতে পেরেছি।আমাকে আরও বেশি সর্তক থাকতে হবে। শিকদের সাথে সম্পর্ক কেমন? জানতে চাইলে সবাই বলে, ভালো। শিকদের সাথে তাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে।
শিকেরা মারধর করে কিনা? জানতে চাইলে তারা সবাই বলে, শিকেরা মাঝে মাঝে মারলে ভালো । কিন্তু তবুও মারলে খারাপ লাগে।
বাব-মা কি তোমাদের বন্ধুকে চেনে? জানতে চাইলে বলে, সবাইকে চেনে না, বন্ধুরা বাড়িতে আসলে বাবা-মা কি স্বাভাবিক ভাবে নেয়? জানতে চাইলে বলে, সবাই বাবা-মা স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয়না। বিশেষ করে মেয়ে বন্ধুরা বাড়িতে আসার ব্যাপারটা সহজভাবে মেনে নিতে চায়না। আসলেই জিজ্ঞেস করে কেন এসেছে?
বাড়িতে বাজার কে করে? জানতে চাইলে সবাই বলে প্রায়, সময় বাবাই করে তবে আমরা মাঝে মাঝে করি। মামুন বলে, বাবা বিদেশ থাকায়, আমি আর মাই বাজার করি।
বাব-মায়ের আর্থিক অবস্থা সম্পর্ক নিয়ে কি ভাবে? জানতে চাইলে সবাই বলে, বাবা- মায়ের আয় নিয়ে ভাবি। বাবামায়ের কাছ থেকে মাঝে মাঝে কি আবদার কর? জানতে চাইলে বলে, মাঝে মাঝে কিছু দরকার হলে চাই। না দিলে কি কিছু কর? জানতে চাইলে সুজন বলে, না দিলে মেজাজ গরম করি। চিত্কার করে কথা বলি। মাঝে মাঝে জিনিস পত্র ভাঙ্গি। খেলাধুলা করলে কিছু কি বলে? জানতে চাইলে বলে, মাঝে মাঝে খেলাধুলা করতে নিষেধ করে।
পরিবারে বাবা-মায়ের কি ঝগড়া হয়? সবাই বলে, প্রায় সময় বাবা-মায়ের ঝগড়া হয়। তখন কেমন লাগে? জানতে চাইল হাসান বলে, তখন মনটা খুব ছোট হয়ে যায়। ইচ্ছে করে তখন বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই। রোকন বলে বাবা-মা ঝগড়া করলে খুব খারাপ লাগে। কোন কাজ করতে এমনকি পড়ালেখা করতেও তখন ভালো লাগে না। তুমি কি বাবা-মাকে বোঝাও? জানতে চাইলে সবাই বলে, মা কে বুঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু বাবাকে বুঝাতে সাহস পাইনা। কারও বাবা ২ বিয়ে করেছে কিনা? জানতে চাইলে সবাই বলে তাদের কারও বাবা দুই বিয়ে করেনি। তবে তাদের এক বন্ধুর বাবা দুই বিয়ে করায় বাবা-মায়ের প্রায় ঝগড়া হয়। তা সহ্য করতে না পেরে তাদের বন্ধু পড়ালেখা ছেড়ে দেয়। এমনকি সে ঘর থেকেও বের হয়ে যায়।
কেউ প্রশংসা করলে বা কোন কাজে উত্সাহ দিলে কেমন লাগে? জানতে চাইলে সবাই বলে কেউ প্রশংসা করলে খুব ভালো লাগে তারা আরও বলে, আমরা ভালো কিছু করলেও আমাদের সামনে কেউ প্রশংসা করেনা। পেছনে করে। বলে যে সামনে প্রশংসা করলে আমরা নাকি সুযোগ পেয়ে যাব।
ভালো কিছু করলে কি ধন্যবাদ দেয়? জানতে চাইলে বলে না কেউ কখনো ধন্যবাদ দেয়না। ধন্যবাদ দেয়াটা কি দরকার? দিলে কি করতে জানতে চাইলে? সবাই বলে ধন্যবাদ দেয়াটা খুবই দরকার। ধন্যবাদ দিলে কাজের স্পৃহা বাড়ে। ঐ ধরনের ভালো কাজ করার ইচ্ছা জাগে মনে। খারাপ রেজাল্ট করলে সবাই কি করে? সবার কাছে এখন কি আশা? জানতে চাইলে বলে, খারাপ রেজাল্ট করলে সবাই বকাবকি করে। যা আশা করি না। আশা করি সবার সান্ত্বনা।
সবাই কি সবার জন্ম দিন জানে? জানতে চাইলে বলে, আমরা অনেকে আমাদের সঠিক জন্ম তারিখ জানি না। বাবা-মা আমাদের জন্ম তারিখের সঠিক হিসাব রাখেনি।
কেউ কি জন্ম দিন পালন করে? জানতে চাইলে বলে, আমরা কেউ আমাদের জন্ম দিন পালন করিনা। কারণ জন্মদিন পালন করার সে সামর্থ্য আমাদের নেই।
পরিবারের কেউ কি এসময় উপহার দেয়? জানতে চাইলে বলে, ‘না, আমাদের জন্ম দিনের কথা আমাদের পরিবারের সদস্যরা মনে রাখে না। কেউ কোন উপহারও দেয়না। এমনকি উইসও করে না। করলে অনেক ভালো লাগত।
পরিবারের সবাই কি একসাথে খেতে বসো? জানতে চাইলে বলে, সবাই একসাথে খায় না।
আলোচনা শেষে অংশগ্রহণকারীরা বলে, ‘এ বয়সটা হচ্ছে ঘুড়ির মতো, কাইট খাইলে শেষ।’

অভিভাবকদের দৃষ্টিভঙ্গি
কিশোর কিশেরীদের সাথে কর্মশালার পর আমরা প্রত্যেক স্কুলের অভিবাবকদের নিয়ে কর্মশালা করি। প্রত্যেক স্কুলে আলাদা আলাদা করে পর পর ৩ দিন কর্মশালার আয়োজন করা হয়। অভিভাবকদের সাথে কর্মশালায় কিশোর কিশোরীদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়গুলো আলোচনার মধ্যে ছিলো।

যে জিজ্ঞাসাগুলো নিয়ে অভিভাবকদের কাছে যাওয়া
বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ সেবা ও পরিচর্যা বিষয়ে অনেক অভিভাবকই অনেকটা উদাসিন। অভিভাবকদের সচেতনতাও অনেক কম দেখা যায়। গবেষণায় যে জিজ্ঞাসাগুলো অভিবাবকদের সামনে তুলে ধরা হয়েছিলো সেগুলো আলোচনার মাধ্যমে চলে আসে। তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো-
১.আপনার সন্তানের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন?
২.সন্তানের বয়ঃসন্ধিকালের বিষয়ে আপনি কি খেয়াল রাখেন?
৩.তার আচার অচরনের প্রতি কি কখনো খেয়াল রাখেন? আপনি কি খুব সতর্ক?
৪.এ সময়টি আসার আগে আপনি কি তাকে আগেই কোনো ধারনা দিয়েছিলেন?
৫.এ সময় আপনি কি তাকে শাসন করেন? শাসনের ধরণ কেমন?
৬.তাকে কি কখনো মারধর করেছেন?
৭.তার কথাকে কি কখনো প্রাধান্য দেন? তাকে কি খুব নিয়ম শৃক্সলার মধ্যে রাখেন?
৮.তার ছোট খাট সাফল্যে তাকে কি প্রশংসা করেন? তাকে কি উপহার দেন? দিলে কি ধরনের?
৯. তার কোনো ভুল হলে তাকে কি কখনো ভত্সনা করেন?
১০.তার মান সন্মানের দিকে কখনো কি ল্য রাখেন?
১১.তার বন্ধু বান্ধবদের কি আপনি চেনেন?
১২.তাকে কি প্রস্রয় দেন? তাকে টাকা পয়সা দেয়ার বেপারে অপনি কি সতর্ক?
১৩.তার শারিরীক পরিবর্তনের সময় তাকে কি কোনো সহযোগীতা করেন? কোনো পরামর্শ দেন? দিলে কি ভাবে? না হলে সে কি ভাবে সমাধান করে?
১৪.পারিবারিক কোনো সমস্যায় তার সাথে কি খোলামেলা অলোচনা করেন?
১৫.পরিবারিক কোনো ঝগড়া ঝাটিতে তার আচার আচরণ কেমন হয়, তাকি কখনো ল্য করেছেন? এর জন্য তার উপর কোনো প্রভাব পড়েছে কিনা তাকি কখনো ল্য রেখেছেন?
১৬.সে কি কোনো কু-অভ্যাসে আসক্ত হয়ে পড়ছে?
১৭.পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে বসে আলাপ আলোচনা বা গল্প করেন?
১৮.পরিবারের সবাই একসাথে বসে কি খাওয়া দাওয়া করেন?
১৯.সন্তানদের নিয়ে একসাথে কি বেড়াতে যান?
২০.নিকট আত্মীয় স্বজনদের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন?
২১.তার ছোট খাট আবদার কি রা করেন?
২২.বাবা মায়ের মধ্যে কার সঙ্গে তার বেশী সম্পর্ক?

আলোচনার এক পর্যায়ে সকলের সাথে মত বিনেময় হয় যে, ‘পিতা মাতার সবচেয়ে বড় সম্পদ তার সন্তান। সন্তানের সাফল্য নিশ্চই সকলে চান। সে শুধু প্রত্যেকের নিজ নিজ সন্তানই নয়, রাষ্ট্রেরও বড় সম্পদ। শিশু কিশোরদের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপিট তার পরিবার। তার সবচেয়ে বড় বন্ধু তার বাবা মা। তার সবচেয়ে বড় সাথী তার পরিবারের সদস্যরা। বয়ঃসন্ধি কালটি জীবনের একটি বড় গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময় তাদের শারীরিক মানসিক নানান পরিবর্তন ঘটে। সে প্রবেশ করে পৃথিবীর এক বিশাল জ্ঞানের জগতে। সে দেখতে পায় প্রকৃতির ননান রহস্যকে। সামান্যতম অবহেলা অবজ্ঞা তাকে বিুব্ধ করে তুলতে পারে। পারিবারিক ও সামাজিক স্নেহ মমতার বন্ধনে এ সময়টি সে সুন্দর ভাবে অতিক্রম করতে পারবে। এ সময়টিতে তার দরকার পারিবারিক ও সামাজিক নিবীড় পরিচর্যা।’

এম.এ. ছাত্তার স্কুল
বয়ঃসন্ধিকালীণ স্বাস্থ্যসেবা ও পরিচর্যা বিষয়ে অভিভাবকদের সাথে আলোচনা সভার মাধ্যমে ২৮ শে আগস্ট এম.এ. ছাত্তার স্কুলে আমাদের ১ম দিনের কার্যক্রম শুরু হয়।
উক্ত আলোচনা সভায় শিার্থীদের অভিভাবক সহ স্কুলের শিক মন্ডলী এবং প্রধান গবেষক মাহ্মুদুল হক ফয়েজ ও এনিমেটর রাবেয়া সুরতানা অংশগ্রহণ করেন।
আলোচনা শুরুর পূর্বে সবাই সবার পরিচয় দেন। পরে অভিভাবকদের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। আলোচনাকালে সন্তানদের সাথে তাদের কেমন সম্পর্ক জানতে চাইলে অভিভাবক পারভীন আক্তার বলেন, ‘ওদের বাবা প্রবাসী। তাই ওদের সব তো এখন আমি । বাবাও আমি আবার মাও আমি। ওদের আদর করি আবার শাসন ও করি। ওদের সাথে হাসি আর ওদের বোঝাই।’
অভিভাবক আবুল কাশেম বলেন, ‘ছেলেমেয়েদের সাথে বন্ধুত্বর্পূণ সম্পর্ক রয়েছে। তবে মেয়েলি ব্যাপারগুলি নিয়ে আমি আমার মেয়ের সাথে আলাপ করিনা। এ ব্যাপারগুলি ওরা মায়ের সাথে আলাপ করে। আমি কখনো এ ব্যাপারে জানতে চাইনি। ওরা যেহেতু লেখাপড়া শিখছে তাই ওরাই সচেতন।’ একজন অভিভাবক বলেন, আমার সন্তানেরা আমাকে ভয় পায় বলে, আমার সাথে কম মেশে, আমার সামনে আসতে চায়না। এমনকি এক টেবিলে বসে ভাতও খায় না।
আরেক অভিভাবব বলেন, ‘আমার সন্তানেরা ওদের মাকে ভয় পায় বলে আমার সাথে বেশি মেশে।’
কখনও কি আপনার সন্তানদের শাসন করেছেন? করলে কিভাবে করেছেন? জানতে চাইলে অভিভাবক আবুল কাশেম বলেন, ‘শাসন করেছি তবে ছোটবেলায় পড়ার সময় কিছু না বুঝলে মারতাম। এখন আর মারি না।’
অভিভাবক পারভীন আক্তার বলেন, ‘এখনকর যুগে গায়ে হাত উঠানো ঠিক না। তাই ওদের বুঝাই।’
এক অভিভাবক বলেন, ‘না মারলে কি সন্তান মানুষ করা যায়?’
না মেরে কি শাসন করা যায়না? জানতে চাইলে স্কুলের এক শিক বলেন, ‘বেত ছাড়া টিচিং করলে ছাত্ররা মানে না, কথা শুনতে চায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঐ স্কুলের শিক সাহাবুদ্দিন ছাত্রদের সবচেয়ে বেশি শাসন করেন। তাই তাঁর কাশে ছাত্রদের উপস্থিতিও বেশি। সবাই স্যারের কথা শোনে, এমনকি অভিভাবকেরাও। কারণ স্যার শুধু বেত দিয়ে শাসন করেননা। তাদেরকে আদরও করেন। আবার সুন্দর করে বোঝানও।’
শিকেরা বলেন, ‘শুধু বেতের শাসন নয়, ভাবের শাসন আর দৃষ্টির শাসনও থাকতে হয়’। তবে সবাই মনে করেন, ‘স্যারদের শিক্ষা কম থাকলে শাসন করলেও তা ফলপ্রসূ হয়না।’
বয়ঃসন্ধিকালের আগে কি সন্তানদের সচেতন করেছেন? জানতে চাইলে, পারভীন আক্তার বলেন, ‘আমি আমার সন্তানকে এসব আগে থেকে জানিয়েছি।’
অভিভাবক আবুল কাশেম বলেন, ‘ওদের মা এ সম্পর্কে ওদের বলেছে।’
স্কুলে মেয়েদের অপ্রস্তুত অবস্থায় ঋতুস্রাব হয়ে গেলে কোন ব্যবস্থা আছে কিনা ? জানতে চাইলে প্রধান শিক আবুল কাশেম বলেন, ‘তাঁর স্কুলে এ ধরনের কোন ব্যবস্থা নেই। তবে থাকলে ভালো হত। আর এটা থাকাটা খুব দরকার বলে তিনি মনে করেন।’
অভিভাবকদের সাথে আলোচনা শেষ করার মাধ্যমে আমরা এম.এ.ছাত্তার স্কুলে আমাদের দিনের কার্যক্রম শেষ করি।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনের কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীঅভিভাবকরা আরো আগ্রহ নিয়ে আলোচনায় যোগ দেন।
আলোচনায়, উক্ত স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সারোয়ার-ই-দীন বলেন, এসময়টি কিশোর কিশোরীদের ক্রান্তিকাল। মনীষী কার্ল মার্কসের একটি উদ্বৃতি দিয়ে তিনি বলেন, একটি কেচোঁ যখন চলতে থাকে এখন সে সোজা পথেই চলে। চলার পথে যখন কোনো পাথর সামনে পড়ে বাধার সৃষ্টি করে, তখন সে সামনে পিছনে গিয়ে বিভিন্ন দিকে তাকিয়ে বিকল্প পথে তার পথ খুঁজে নেয়। এবং একসময় পাথর অতিক্রম করে আবার তার পথ চলা শুরু করে।
ঠিক তেমনি কিশোর কিশোরীদের চলার পথও এরকম। তাদের চলার পথে কোন বাধা দিলে সে বক্র পথে চলে যায়, কখনো কখনো সে বিগড়ে যায়। তাই তাদের চলার পথটি সবসময় মসৃণ রাখতে হবে, তাদের চলাটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে হবে। তিনি বলেন, এ কাজটা করতে পারে অভিভাবক ও সমাজ। অন্য অভিভাবকরা এ সময়টা জীবনের বাঁক বলে মন্তব্য করেন।



হাসান হাট উচ্চ বিদ্যালয়
হাসান হাট উচ্চ বিদ্যালয়ে অভিভাবকদের পরপর ৩টি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
কর্ম শালায় হাসান আট হাই স্কুলের অভিভাবকরা নানান আলোচনায় অংশগ্রহন করেন। স্কুলের সহকারী প্রধান শিক বলেন, এ বিষয়ে বেশি আলাপ না করাই ভালো। মেয়েরা নিজেরাই তাদের ব্যাপারগুলো বোঝে। অভিভাবক গোলাম মাওলা বলেন, এ ব্যাপারে ওদের মা খেয়াল রাখেন। অভিভাবক দেবব্রত দাস বলেন, ছেলেমেয়েদের এসব ব্যাপার তাদের মারা দেখাই ভালো।
অভিভাবক রাজলী চ্যাটার্জি বলেন, মেয়েরা এসব ব্যাপারে এখন নিজেরাই সচেতন তাই আলাপ করেননা। সন্তানদের মারধর করার বিষয়ে অভিভাবক গোলাম মাওলা বলেন, ছোটকালে মারলেও এখন মারিনা। স্কুলের শিক গোলাম মাওলা বলেন, স্কুলে মেয়েদের শাসন করার জন্য বেত ব্যবহার করা হয়। মারলে তারা বিুদ্ধ হয়। তিনি মনে করেন, বাচ্চাদের মারা উচিত্ নয়। ছেলেমেয়েদের সাথে একসাথে খাবার খান কিনা? জানতে চাইলে অভিভাবক ইসমাইল হেসেন বলেন, মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েদের সাথে একসাথে খেতে বসলেও কথাবার্তা বা গল্প করা হয়না। স্কুলে মেয়েদের মাসিক অর্থাত্ ঋতুস্রাবের সময় কোন ব্যবস্থা আছে কিনা? জানতে চাইলে স্কুলের শিক্ষয়িত্রী রাজলী চ্যাটার্জি বলেন, এ ধরণের কোন ব্যবস্থা স্কুলে নেই, এমনকি স্কুলে মেয়েদের আলাদা কমনরুম বা ড্রেসিংরুমও নেই। তবে এ অবস্থায় মেয়েরা ছুটি চাইলে ছুটি দেওয়া হয়। অভিভাবকরা সবাই এক মত হয়ে বলেন, স্কুলে এধরণের কোন ব্যবস্থা না থাকায় এসময় মেয়েরা ৬/৭ দিন স্কুলে আসেনা। তাই সবাই মনে করে স্কুলে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে আরও ভালো হত। এবং অভিভাবক হিসাবে বাবা-মাকে এসময় আরও সর্তক হতে হবে।


আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়
আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে অভিভাবকদের পরপর ৩টি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় সবাই ছিলেন শত:স্ফূর্ত।
মামুনের বোন শাহানারা বেগম বলেন, ৫ বোনের এক ভাই মামুন। ৪র্থ/৫ম শ্রেণীতে উঠার পর তার পরিবর্তন শুরু হয়। আগে সে ঘর থেকে বের হতনা। এখন প্রায় সময় বাইরেই আড্ডা দিয়ে সময় কাটায় সে। কারও কথা শুনে না। সবার সঙ্গে একসাথে খাবার খায় না। শাহানারা বেগম আরও বলেন, আমার বাবা খুব রাগী। আগে ওকে খুব মারধর করত। আমরাও ওর সাথে খুব কম কথা বলি। শাহানারা আরো বলেন, আমরা সবাই ফলের আশা করি। কিন্তু গাছের পরিচর্যা ঠিক মত করিনা। তেমনি আমরা সবাই ওদের কাছে ভালো কিছু আশা করি। কিন্তু উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের বুঝতে না পেরে ওদের সাথে ভালো ব্যবহার করিনা।
আপনার সন্তানের সাথে সম্পর্ক কেমন? জানতে চাইলে রোকনের বাবা মোঃ মোস্তফা বলেন, আমার সাথে ওর সম্পর্ক মোটামুটি ভালো। ও পড়ালেখা ভালো করার জন্য ওর ভাব ভঙ্গিমা আর মনের কথা জানার চেষ্টা করি। এ সময় কয়জন অভিভাবক বলেন, বর্তমান যুগ বেশি ভালোনা। তাই বেশি বন্ধু সুলভ আচরণ করিনা। করলে ও আশকারা পেয়ে যাবে।
অভিভাবক তাজুল ইসলাম বলেন, আমি আমার সন্তানের খোঁজ খবর নিই।
সন্তানের বয়ঃসন্ধিকালের বিষয়ে কি খেয়াল রাখেন? জানতে চাইলে সবাই বলেন ‘না, এ ব্যাপারে আমরা কোনো প্রকার খেয়াল করিনা।
সন্তানদের কি শাসন করেন? জানতে চাইলে সবাই বেলন, ভূল করলে তো শাসন করবই। তবে যখন থেকে বুঝলাম ওরা বড় হচ্ছে তখন থেকে মারধর করিনা। মারলে কখনো শুধরায় না। ছেলেমেয়েদের সাথে নিবীড় সান্বিধ্যের জন্য পারিবারিক আলাপ আলোচনার বিকল্প নেই। এ ব্যপারে অভিভাবকরা বলেন, ‘ছেলেমেয়েদের সময় দিইনা। তাদের সাথে বসে গল্প করা হয়না।’
আপনি কি আপনার ছেলের বন্ধুদের চেনেন? ওদের কিভাবে দেখেন? জানতে চাইলে অভিভাবক শাহীন বলেন, ওদের সব বন্ধুকে চিনি না। ভালো বন্ধুদের সাথে মিশলে মিশতে দিই। কিন্তু খারাপ বন্ধুদের সাথে মিশলে বাধা দিই।
আরেক অভিভাবক বলেন, ছেলে মেয়েরা কার সাথে মেশে এ ব্যাপারে বাবা মায়ের সচেতন হওয়া দরকার। আলোচনায় অভিভাবকরা বলেন এসব বিষয়ে পাঠ্যপুস্তকে থাকা দরকার।

তিনটি স্কুলের অভিভাবকদের মাঝে প্রায় একই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিধ্বনিত হয়।



গবেষণায় যে বিষয়গুলো পওয়া গেছে

১.এ সময় কিশোর কিশোরীরা হয়ে পড়ে চঞ্চল এক রোখা
২.এ বয়সে তাদের মন মানসিকতায় উদাসিনতার ভাব ল্য করা যায়
৩.এ বয়সে ছেলে ও মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তন শুরু হয়।
৪.মেয়েদের স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক আগেই ঋতুস্রাব হয়ে যায়।
৫.মেয়েরা লজ্জায় এ বিষয়টি নিয়ে কারো সাথে আলাপআলোচনা করেনা।
৬.অনেক মেয়ে জটিল মেয়েলী রোগে ভুগছে
৭.এ সময় তারা টোটকা ঔষুধ ব্যাবহার করে
৮.মা বাবারা প্রায় ত্রে থাকেন উদাসিন
৯.কেউ কেউ লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে।
১০.ছেলেদের নতুন দাড়িমোচ উঠলে লজ্জা পায়।
১১.ছেলেদের ঘন ঘন স্বপ্নদোষ হয়।
১২.ছেলেরা হস্তমৈথুনে অভ্যস্ত।
১৩.আনেক ছেলে মাদকে আসক্ত ।
১৪.ছেলেরা বন্ধুদের সাথে সমকামিতায় লিপ্ত হয়।
১৫.বাবা মায়েরা এদেরকে বুঝতে পারেনা।
১৬.বাবা মায়েরা মারধর করেন।
১৭.সমাজ এদেরকে সন্দেহের চোখে দেখে।
১৮. পড়ালেখায় অমনযোগী।
১৯.ঋতুকালীন সময়ে স্কুলে মেয়েদের জন্য ফাষ্টএইডের ব্যবস্থানেই।
২০.স্কুলে মেয়েদের জন্য ড্রেসিংরুম নেই
২১.ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের শিার হার বেশী।
২২.এ বয়সে মেয়েরা খেলাধুলো করলে সমাজ ভালো চোখে দেখেনা।



সুপারিশ:
১.কিশোর কিশোরীদের মারধর না করে তাদের সাথে বন্ধুত্বপুর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে অভিভাবকদের মাঝে সচেতনতা গড়ে তোলা।
২.স্কুলে ছাত্র ছাত্রীদের মারধর, নির্যাতন বা শারিরীক শাস্তি না দিয়ে ওদের প্রতি আরো বেশী মনোযোগী হওয়া।
৩.বয়ঃসন্ধিকাল বিষয়ে পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা।
৪.প্রত্যক স্কুলে মেয়েদের ঋতুকালীন সময়ের জন্য ফাষ্টএইডের ব্যাবস্থা করা।
৫.প্রত্যেক স্কুলে মেয়েদের বাথরুমের পাশে ড্রেসিংরুমের ব্যাবস্থা করা।
৬.হস্তমৈথুন, সমকামিতার কুফল সম্পর্কে কিশোরদের মাঝে প্রচারণা চালানো।
৭.স্কুল হেল্থ কিনিকে বয়ঃসন্ধিকালীন বিশেষ স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা।
৮.প্রত্যেক স্কুলে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের প্রসার করা।
৯.স্কুল গুলোতে লইব্রেরী পঠচক্র এবং নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
৯.যে কোনো সাফল্যে এদেরকে সামাজিক ভাবে পুরষ্কৃত করা ও বিশেষ ভাবে সন্মান করা।
১০.সামাজিক ও জনকল্যান মুলক কাজে কিশোর কিশোরীদের সম্পৃক্ত করা










নোয়াখালীর চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত দরিদ্র নারীদের আর্থ-সামাজিক ও জীবন যাত্রার মানোন্নয়নের পন্থা উদ্ভাবন।
















গবেষণার উপস্থাপনা





নোয়াখালীর চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত
দরিদ্র নারীদের আর্থ-সামাজিক ও জীবন যাত্রার
মানোন্নয়নের পন্থা উদ্ভাবন।


গবেষক-: মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ :





গবেষণার শিরনাম :- নোয়াখালীর চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত দরিদ্র নারীদের
আর্থ-সামাজিক ও জীবন যাত্রার মানোন্নয়নের পন্থা উদ্ভাবন




গবেষণা টিমে যাঁরা রয়েছেন :

১. মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ প্রধান গবেষক
২. নিলুফার আক্তার গবেষণা সহযোগী
৩. শাহানা আক্তার শাহিন এনিমেটর
৪. খালেদা আক্তার লাবনী এনিমেটর
৫. মারজাহান সুলতানা মার্জু এনিমেটর
৬. আনোয়ারা বেগম আর্জু এনিমেটর
৭. নাসির উদ্দিন শাহ্ নয়ন এনিমেটর




গবেষণার মেয়াদকাল : ৬ (ছয়) মাস।
১ জুলাই, ২০০৪ইং থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ২০০৪ইং

পদ্ধতি : অংশগ্রণমূলক কর্ম গবেষণা

সহায়তায় : রিসার্র্চ ইনিশিয়েটিভস্, বাংলাদেশ (রিইব)







গবেষণার সার সংক্ষেপ

নোয়াখালী জেলার উপকূলীয় অঞ্চলের নির্দিষ্ট কিছু এলাকার নারীরা চাটাই শিল্পের সাথে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত রয়েছে। বিশেষ করে জেলার দক্ষিণাঞ্চলের সুধারাম থানার সাহেবের হাট, চর মটুয়া, খলিফার হাট, এওজবালিয়া, ইসলামগঞ্জসহ এক ব্যাপক এলাকায় এগুলো তৈরী হয়। নিম্ন আয়ের দরিদ্র প্রতিটি ঘরে ঘরেই নারীরা এই শিল্পের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। উপকূলীয় পলিমাটি সমৃদ্ধ এই এলাকায় চাটাই পাতা প্রচুর উৎপন্ন হয়। কোন রকম চাষাবাদ ছাড়াই নীচু জমিতে এই পাতার গাছ আপনাতেই জন্মে। স্থানীয় ভাষায় এটি হোগলা নামেই পরিচিত। হোগলা পাতা দিয়ে সাধারণতঃ চাটাই বা বিছানা তৈরী হয়। এই চাটাই নিম্ন আয়ের জনগণ ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ বিছানা হিসেবে ব্যবহার করে। তাছাড়া ঘরের ছাউনী, বেড়া ও ফসল রাখার টুকরী বানানোর জন্যও এই পাতা ব্যবহার হয়। এটি একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ শিল্পও বটে। হোগলা পাতা দিয়ে চাটাই তৈরীর কাজ প্রধানতঃ নারীরাই করে থাকে। নোয়াখালীর এই অঞ্চল থেকে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার চাটাই তৈরী হয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানী হয়। সিলেট, ব্রাক্ষ্মনবাড়ীয়া, রংপুর, ঢাকা, চট্রগ্রামসহ দেশের উত্তরাংশে বছরে কয়েক কোটি টাকার চাটাই চালান হয়। যে সব অঞ্চলে এর ব্যাপক বাজার রয়েছে। আনুমানিক চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার নারী অত্যান্ত দতার সাথে প্রতিদিন নিরলস ভাবে চাটাই তৈরী করে থাকে। কিন্তু মধ্যস্বত্ব ভোগী দালাল, ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা নারীদের এই অকান্ত শ্রমকে জিম্মি করে রেখেছে। তাদের শ্রমের কোন মূল্য দেয়া হয় না। নানান কৌশলে নাম মাত্র মূল্যে ফড়িয়ারা নারীদের কাছ থেকে চাটাই কিনে নেয়। ফলে উত্পাদনকারী বিপুল সংখ্যক নারীরা তাদের শ্রম মূল্য না পেয়ে অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। এই নারীদের অধিকাংশই সম্পূর্ণ নিরক্ষর। এর ফলে একদিকে যেমন এই সম্ভাবনাময় শিল্পটি দিন দিন ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে অন্যদিকে এই নারীদেরও জীবনের কোনো পরিবর্তন হয়নি।

চাটাই সাধারণতঃ নিম্ন আয়ের মানুষ বেশী ব্যবহার করে। দামেও এটি অপোকৃত কম। তাই একে গরিবের বিছানা নামে অনেকেই অবহিত করেন। বিভিন্ন চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এ শিল্পটির বিপুল সম্ভাবনার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এর কোনে প্রসার ঘটেনি।

এই পরিপ্রেক্ষিতে চাটাই শিল্পের সঙ্গে জড়িত জনগোষ্ঠীর উপর ব্যাপক গবেষণার লে রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস্ বাংলাদেশ (রিইব) এর সহযোগিতায় নোয়াখালী সুধারাম উপজেলার কয়টি প্রত্যন্ত গ্রামে এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কি করে এই নারীদের আরো বেশী সহযোগিতা করা যায় এবং মধ্যস্বত্বভোগী দালাল চক্র থেকে উদ্ধার করে আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো যায় সে উদ্দেশ্যেই মূলত এ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে।



নোয়াখালীর এ গ্রামগুলো হোগলা শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে পর্যায়ক্রমে এ শিল্পটি বিকাশ লাভ করেছে। এক সময় মেঘনার মোহনায় এই এলাকা গুলো ভেঙ্গে গেলে পলিমাটি সমৃদ্ধ পয়স্তি নীচু জমিতে হোগলা গাছ উৎপন্ন হয়েছে। সাধারনতঃ নতুন জেগে উঠা প্রকৃতিকভাবেই এ গাছ বংশ বিস্তার করে। এলাকার মানুষ প্রায় বিনা শ্রমেই এগুলো পেয়ে থাকে। যার কারণে ঐ এলাকায় হোগলা পাতা দিয়ে তৈরী চাটাই শিল্প প্রসার লাভ করেছে। এ পেশায় সাধারনতঃ ঐ এলাকার নারীরাই জড়িত। এ শিল্পটি নারী শ্রমিকদের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। এ এলাকায় এমন কোন বাড়ী পাওয়া যাবেনা যেখানে নারীরা একাজে নেই। এই নারীরা অসম্ভব পরিশ্রমী ও নিবেদিত প্রাণ। শ্রমজীবি গ্রামীণ এ নারীরা অবদান রাখছে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে। এটি একটি চলমান শিল্প এবং ক্ষয়িষ্ণুও নয়। কিন্তু এর পেছনের সুদ কারিগর নারীরা রয়ে গেছে বঞ্চিত শোষিত ও ঋণগ্রস্থু হয়ে। দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রম করেও এরা এদের অভাব ঘুচাতে পারেনি




ছয় মাস ব্যাপী এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে সম্পূর্ণ অংশগ্রহণমূলক কর্ম গবেষণা পদ্ধতিতে। কর্ম এলাকায় পাঁচটি গ্রুপ করে পাঁচ জন এনিমেটর গবেষণার কাজ পরিচালনা করেছেন। এ গবেষণায় মূলত গবেষক ছিলেন চাটাই শিল্পের নারীরা । ১ জুলাই ২০০৪ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০০৪ পর্যন্ত ৬ মাস ব্যাপী ছিলো এর সময়কাল। গবেষণা করতে গিয়ে প্রথমে এনিমেটর টিমকে এক কঠিন বাস্তবতার মধ্যে পড়তে হয়েছিলো। গ্রামের নারীরা প্রথমে দাবি করে বসেছিলো তাদেরকে রিলিফ বা অনুদান দিতে হবে। অন্তত প্রতিশ্র“তি দেওয়া জন্য তারা পিড়াপিড়ি করে। কিন্তু এ গবেষণাটি ছিলো গতানুগতিক গবেষণার বাইরে একেবারেই ভিন্ন আঙ্গিকের। কোনো রকম প্রতিশ্রুতিতে গবেষণা টিমটি ছিলো একেবারেই অপরাগ। দুটি যায়গা থেকে এদের চলেও আসতে হয়েছে। পরে যখন গবেষণা শুরু হলো তখন এই নারীরা বুঝতে পারলেন দান খয়রাত অনুদান কি ভাবে এদেরকে অবদমিত করে রেখেছে। তাঁরা বুঝতে পারলেন তাঁদের ভিতরে রয়েছে এক অসাধারণ মতা। এর সঠিক ব্যবহারেই তাদের অবস্থার পরিবর্তন করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন একটু সহায়ক পরিবেশ। শত শত বছর ধরে নারীদের মধ্যে যে কুসংস্কার পাথর চাপা দিয়ে অচলায়তন সৃষ্টি করে রেখেছে তা সামান্য এ কয় দিনের গবেষণায় সরানো সম্ভব নয়। তবে এ গবেষণার ফলে তাদের চিন্তা চেতনায় আশাপ্রদ পরিবর্তন ন্য করা গেছে।

এ গবেষণাটি পরিচালনা করার জন্য মূল গবেষক, একজন সহযোগী গবেষক ও পাঁচ জন মাঠ পর্যাযের এনিমেটর বা উজ্জীবক নিয়ে সাত জনের একটি দল গঠন করা হয়েছিলো। এর জন্য নির্দিষ্ট অঞ্চলের পাঁচটি স্পট ঠিক করা হয়। সে নির্দিষ্ট এলাকার নারীদের নিয়েই এ গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত ভাবে গবেষক নারীরা দলীয় অলোচনা ও গবেষণায় অংশগ্রহন করে। এরপর মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতার আলোকে গষেণার পুরো টিমকে নিয়ে নিয়মিত সাপ্তাহিক কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। এ কর্মশালার মাধ্যমে গবেষণার অগ্রগতি পর্যালোচনা ও পরবর্তী সপ্তাহের কার্যক্রমের পরিকল্পনা করা হয়েছ। প্রতি সপ্তাহে এনিমেটররা প্রত্যেকে একটি করে রিপোর্ট করেছেন এবং সব শেষে রিপোর্ট গুলো সমন্বয় করে একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরী করা হয়েছে। গবেষণাকালে এলাকার বিভিন্ন মানুষের সাাৎকার গ্রহণ করা হয়। এ ছাড়াও শতাধিক ষ্টিল ছবিও তোলা হয়েছে।



নোয়াখালীর চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত দরিদ্র নারীদের
আর্থ-সামাজিক ও জীবন যাত্রার মানোন্নয়নের পন্থা উদ্ভাবন

গবেষণার উপস্থাপনা

গবেষণার ধারণা :

নোয়াখালী জেলার দণি পশ্চিমাঞ্চলের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের প্রায় লাধিক দরিদ্র নারীরা চাটাই শিল্পের সাথে প্রত্যভাবে জড়িত রয়েছে। যুগ যুগ ধরে এ শিল্পের সাথে জড়িত থেকেও তারা তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন করতে পারেনি। অনেক নারী ঋণের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। ঋণ এবং অনুদান সর্বদা এদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এই দরিদ্র নারীদের আর্থ-সামাজিক জীবন ুদ্র গন্ডির মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে আছে। দিন ও রাত তাদের জীবন একই চক্রের মধ্যে ঘূর্ণিয়মান হচ্ছে। এ নারীরা অসম্ভব পরিশ্রমী ও নিবেদিত প্রাণ। শ্রমজীবী এ গ্রামীণ নারীরা অবদান রাখছে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে। অথচ এ শিল্পটি য়িষ্ণুও নয়। এর পিছনের কারিগর নারীরা রয়ে গেছে বঞ্চিত শোষিত ঋণগ্রস্থ হয়ে। তাদের জীবনে কোন বিনোদন নেই, খুব স্বপ্নচারীও তারা নয়। শুধু আকুতি রয়েছে একটু বেঁচে থাকার এদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সরকারী বেসরকারী কোন পর্যায়ে থেকেই এ যাবত কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। চিন্তা চেতনার দিক দিয়েও এরা এক বৈচিত্র্যহীন জীবনের ঘানি টেনে যাচ্ছে। অথচ এ নারীদের মধ্যেই নিহিত রয়েছে অসাধারণ এক সম্ভাবনার পথ।

চাটাই পাতা বা হোগলা পাতা

যে গাছের পাতা দিয়ে চাটাই তৈরী করা হয়, স্থানীয় ভাষায় একে হোগলা পাতা বলা হয়। এটি তৃণ জাতীয় উদ্ভিদ। উপকূলীয় পলিমাটিতে এ গাছটি আপনাতেই জন্মে। এ গাছটি লম্বায় ১২ থেকে ১৫ ফুট হয়ে থাকে। নোয়াখালীতে প্রায় ৩২৫ হেক্টর জমিতে হোগলা পাতার চাষ হয়। প্রায় এক ইঞ্চি ব্যাসার্ধের ত্রিকোণাকৃতি মাংসল পাতা এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ পাতা দিয়ে চাটাই বা বিছানা তৈরী করলে বিছানাটি নরম ও আরামপ্রদ হয়। নিম্নবিত্ত ও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ এটি ব্যবহার করে। তাছাড়াও দড়ি, ঘর তৈরী, বেড়া, তাজা ফল মূল বা কোন কিছু পরিবহনের জন্য টুকরী বানিয়ে এর ব্যাপক ব্যবহার হয়। এটি ১০০% পরিবেশ সম্মত। ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে সারা বছরই এটি জন্মে। গবেষণা প্রকল্প এলাকার প্রতিটি গ্রামেই হোগলা পাতার বন পরিদৃষ্ট হয়।

বাজার ব্যবস্থাপনা :

হোগলা পাতা দিয়ে উৎপাদিত পণ্য বিশেষ করে আভ্যন্তরীণ বাজারেই সরবরাহ করা হয়। নোয়াখালীর কয়টি গ্রামীণ বাজার এ পণ্যের জন্য বিখ্যাত। প্রতি সপ্তাহে ল ল টাকার পণ্য এখানে বেচা কেনা হয়। এখান থেকে ব্যবসায়ীরা সিলেট, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করে। বিদেশের বাজারে হোগলা পাতা দিয়ে তৈরী উচ্চমানের হস্তশিল্প তৈরী করে দু’একটি প্রতিষ্ঠান রপ্তানী করছে। বিদেশে এর ব্যাপক চাহিদা থাকলেও এর প্রসার এখনো তেমন ঘটেনি। স্থানীয়ভাবে ফড়িয়ারা এর বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। গ্রামীণ নারীদের কাছ থেকে খুবই অল্প দামে কিনে এরা অধিক মুনাফায় দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে। এর জন্য গড়ে উঠেছে একটি ফড়িয়া চক্র। চাটাই শিল্পের নারীদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে এ চক্রটি মুনাফা লুটে নিচ্ছে।

অমিত সম্ভাবনা

হোগলা পাতার এ শিল্পটির রয়েছে এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা। এ থেকে পরিবেশ সম্মত পণ্য উৎপাদন হয় বিধায় এর ব্যাপক চাহিদাও রয়েছে। তবে প্রচারের অভাবে এটি তেমন বিকাশ লাভ করেনি। ছোট বিছানা, নামাজের মাদুর, কুশন, ঝুড়ি, টুপি, ছোট ব্যাগ, টুকরী, ঘরের নানান ধরণের ওয়ালম্যাট, এল্টিক্স, হাত পাখা ইত্যাদি নানান পণ্য এ থেকে উৎপাদিত হতে পারে। বিদেশেও এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। নানান গবেষণার মাধ্যমে এর বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার খুঁজে বের করে একে আরো জনপ্রিয় করে গড়ে তোলা সম্ভব। এছাড়া মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়াদের কাছ থেকে এর বাজারকে উদ্ধার করে গ্রামীণ নারীদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে এ শিল্পের সাথে জড়িত নারীরা প্রত্য উপকৃত হবে।

গবেষণার লক্ষ্য :

 চাটাই শিল্পে জড়িত নারীদের জীবন চিত্র তুলে ধরা।
 এদের শ্রমের ধরণ ও জীবিকার সংকটের কারণ অনুসন্ধান করা।
 প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সংকটের কারণ ও তার সমাধানের পন্থার আলোকে পুনরায় গবেষণা করা যায় কিনা সে বিষয়ে দিক নির্দেশনা প্রদান করা।

সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য :

চাটাই শিল্পে জড়িত নারীদের জীবনমান উন্নয়ন এবং তাদের দুর্ভোগ নিরসনের পন্থা উদ্ভাবন।

গবেষণার স্থান :

নোয়াখালী জেলার সদর থানার দণিাঞ্চলের এওজবালিয়া, কালাদরাপ, চরমটুয়া ইউনিয়নের কয়টি গ্রামে এ গবেষণার স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। নোয়াখালী শহর থেকে এ স্থানগুলো ১৫ থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এ সব স্থানগুলো ঘন বসতিপূর্ণ নিবিড় নিভৃত গ্রাম। শহর থেকে এ গ্রামগুলোতে যোগাযোগের ব্যবস্থা মোটামুটি ভাল। যাতায়াতের জন্য রিক্সা, টেম্পু, টেক্সি ইত্যাদি রয়েছে। এলাকাটি মূলতঃ কৃষি প্রধান। এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। ধান এখানকার প্রধান কৃষি পণ্য। মৌসুমে এখানে প্রচুর শাক সব্জী উৎপন্ন হয়। গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হোগলা পাতার বন।


টেবিল নং-১

গবেষণা সম্পর্কে অংশগ্রহণকারী নারীদের ধারণা :

১ আমরা কয়েকজন মিলে কথা বলছি, এটাই হলো গবেষণা।
২ কয়েক জন মিলে যুক্তি করে কিছু করাই গবেষণা।
৩ নতুন কিছু তৈরী করা।
৪ অজানা বিষয়কে জানা।
৫ যেমন আমরা চাটাই বানাই, কাটি, বাছাই করি, তারপর বানাই, বিক্রি করি। আবার আপনি এটা নিয়ে কথা বলেন, এটাই হলো গবেষণা।

যেভাবে গবেষণা পরিচালিত হয়েছে :

এই গবেষণাটি সম্পূর্ণ অংশগ্রহণমূলক কর্ম গবেষণার পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়েছে। এটি অংশগ্রহণমূলক কর্ম গবেষণা। এ গবেষণা পদ্ধতিটিতে কোনো ভাবেই গতানুগতিক অন্যান্য গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। এ গবেষণাটি পরিচালনার জন্য মূল গবেষক, একজন সহযোগী গবেষক ও পাঁচ জন মাঠ পর্যায়ের এনিমেটর বা উজ্জীবক নিয়ে সাত জনের একটি দল গঠন করা হয়েছে। এর জন্য নোয়াখালীর সদর উপজেলার নির্দিষ্ট অঞ্চলের পাঁচটি স্পট ঠিক করা হয়েছে। সে নির্দিষ্ট এলাকার নারীদেরনিয়েই এ গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। এগুলো হলো :

১. জুম্মারাগো বাড়ী,
কালাদরাপ ইউনিয়ন,
রাহামুড়ী তালুক গ্রাম।
২. দপ্তরী বাড়ী,
পূর্ব এওজবালিয়া ইউনিয়ন,
সাহেবের হাট।
৩. রুহুল আমিনের বাড়ী,
বরাইপুর গ্রাম ,
কালাদরাপ ইউনিয়ন ।
৪. আবুল খায়ের মিয়ার বাড়ী,
পূর্ব এওজবালিয়া,
শান্তিনগর গ্রাম।
৫. আকরাম খাঁ মেম্বার বাড়ী,
এওজবালিয়া গ্রাম।

এই পাঁচটি স্পটে নারীদের নিয়ে গবেষক দল গঠন করা হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে গবেষক নারীরা দলীয় আলোচনা ও গবেষণায় অংশগ্রহণ করে। গবেষণার উজ্জীবকরা প্রতিটি দলে সমন্বয়কের কাজ করেছেন মাত্র। এক একটি স্পটের এক একটি দলে একজন উজ্জীবক দায়িত্ব পালন করেছেন। গবেষকরা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের বিষয় সমস্যা আলোচনা করেছেন। এক একদিন এক এক বিষয় নিয়ে তারা গবেষণা করেছেন। সেই গবেষণার বিষয়গুলো উজ্জীবকরা গভীর পর্যবেণ করেছেন এবং এর ভিত্তিতে রিপোর্ট তৈরী করা হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে মাঠের অভিজ্ঞতার আলোকে গবেষণার পুরো টিম নিয়ে সপ্তাহে একদিনের কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। এ কর্মশালাগুলোতে সকলে মাঠের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন এবং এ থেকে পরবর্তী সপ্তাহের জন্য কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়। মাঠ পর্যায়ের ভুলত্রু টি সুবিধা অসুবিধা গুলো আলোচনা করে এর মাধ্যমে একটি নতুন দিক নির্দেশনা খুঁজে পাওয়া গেছে। এর ভিত্তিতে সকলেই সাপ্তাহিক রিপোর্ট ও মাস শেষে মাসিক রিপোর্ট / প্রতিবেদন তৈরী করেছেন। এ থেকে গবেষণার একটি সুশৃঙ্খল ডকুমেন্টশন করা হয়েছে। গবেষণা চলাকালীন বিভিন্ন ফটোগ্রাফ নেয়া হয়েছে। এ পদ্ধতিতে গবেষণা করার ফলে এমন কতগুলো বিষয় উঠে এসেছে যা আগে ধারণা করা হয়নি। প্রথম প্রথম মাঠ পর্যায়ে গবেষণা দল গঠন করতে গিয়ে গ্রামের অনেকেই জানতে চেয়েছেন ঋণ কিংবা রিলিফ দেওয়া হবে কিনা। গবেষণা টিমের প থেকে এর ফলে একটি কঠিন বাস্তবতার মধ্যেই পড়তে হয়েছিলো। ঋণ ও রিলিফ / অনুদান ছাড়া অনেকে কথা বলতেই নারাজ ছিলো। দুই জায়গা থেকে গবেষণা টিমকে ফিরেও আসতে হয়েছে। পরে যখন গবেষণা শুরু হলো তখন গ্রামীণ এই নারীরা আশ্চর্যরকম ভাবে পরিবর্তিত হয়ে উঠলো। অনেকেই নিজেদেরকে খুঁজে পেতে লাগলো। এরা এখন খুবই আগ্রহী ও উৎসুক। তারা ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছে রিলিফ অনুদান দিয়ে নয়, নিজের ভিতরের মতা ও শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন করা সম্ভব।

গবেষণা যেভাবে সমন্বয় করা হয়েছে :

প্রধান গবেষক পুরো গবেষণার সমন্বয় ও পরিচালনা করেছেন। গবেষণার সকল বিষয় পরিচালনার জন্য তিনি একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। পাঁচ জন এনিমেটরের প্রতি সপ্তাহের মাঠের জরিপ ও গবেষণা নিয়ে সকলের রিপোর্ট জমা হলে গবেষক ও সহযোগী গবেষক এ নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন। গবেষণার ধারাবাহিকতা রার জন্য সকলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা গ্রহন করা হয়। প্রতি সপ্তাহের কর্মশালায় প্রধান গবেষক কর্মশালার পরিচালনা করেন এবং প্রধান সমন্বয়ক হিসাবে কাজ করেন। এনিমেটররা যেহেতু অধিকাংশই নারী সংবাদকর্মী সুতরাং গ্রামের নারীদের সাথে এরা সহজে মিশে দ্রুত কাজ করতে পেরেছেন। মাঠ পর্যায়ে এ বিষয়ে প্রাথমিক সাফল্য পাওয়া গেছে। গ্রামীণ নারীরাও খুব সহজে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এদের সাথে মিশে গেছেন। নারীরা তাদের কষ্ট বেদনার কথা উজাড় করে বলতে পেরেছেন। অংশগ্রহণমূলক কর্ম গবেষণার জন্য যা অত্যন্ত জরুরী। গবেষক এনিমেরদের জন্য এটি স্পর্শকাতর হৃদয়ঘন উষ্ণ অভিজ্ঞতা। প্রাথমিকভাবে গবেষণায় নারীদের সম্বন্ধে যে বিষয়গুলো জানা গেছে তা হলো-



তারা যে চিন্তাগুলো ধারণ করে আছে

 নারীরা খুবই সীমিত গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ।
 পুরুষরাই শ্রেষ্ঠ। নারীদের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকার রয়েছে পুরুষদের।
 নারীদের সৃষ্টি হয়েছে পুরুষদের সেবা দাসী হিসাবে।
 পুরুষের বাম পাঁজড় থেকে নারীর সৃষ্টি।
 রান্না বান্না ঘর সংসারের কাজ করবে নারীরা।
 পুরুষ এবং নারী উভয়ে ভিন্ন ভিন্ন জাত।
 পুরুষের পায়ের নীচে নারীর বেহেস্ত। স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর বেহেস্ত।

অর্থনৈতিক পর্যবেণ :

 এলাকার ৮০% নারীরা চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত।
 চাটাই বিক্রির টাকা এরা স্বামীদের হাতে তুলে দেয়।
 ৯৫% পরিবার খুবই নিম্ন আয়ের।
 উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পায় না।
 ৬০% নারী কোন না কোন ভাবে ঋণগ্রস্থ।
 সিলেট, রংপুর, চট্টগ্রাম ইত্যাদি অঞ্চলে চাটাইয়ের প্রচুর চাহিদ রয়েছে।
সামাজিক পরিবেশ, স্বাস্থ্য :

 ৯৮% পরিবার খোলা পায়খানা ব্যবহার করে।
 ১০০% পরিবার পুকুর ব্যবহার করে।
 কবিরাজ, হাতুড়ে ডাক্তার, গ্রাম ডাক্তার, তাবিজ তুমার ইত্যাদির উপর ভরসা করে।
 নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা নেই। শিক্ষার হার খুবই কম।

চাটাই তৈরী :

 চাটাই তৈরীতে নারীরা বিভিন্ন সময় নির্ধারণ করে থাকে।
 রাত্রীতে চাঁদের আলোতে চাটাই তৈরী হয়।
 ভোরের কুয়াশা, ভেজা আবহাওয়ায়, ছায়াযুক্ত মাটিতে নারীরা চাটাই তৈরী করে।
 বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে চাটাই তৈরীর হাতে খড়ি হয়।
 চাটাই ছাড়া অন্য কোন পণ্য তৈরী করেনা।
 ফড়িয়ারা চাটাইয়ের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।
 কুটির শিল্পের কোন প্রশিণ এরা পায়নি।
 প্রশিণ পেলে অনেক নতুন বৈচিত্র্যময় পণ্য তৈরী করা সম্ভব, যা দেশে ও বিদেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে।





সুখ যন্ত্রণার অনুকাব্য :

বৈচিত্র্যহীন জীবনের ুদ্র গন্ডির মধ্যে বসবাস করলেও প্রাণের স্বপ্নিল কষ্ট যন্ত্রণাগুলো কাজের ছন্দে ছন্দে মাঝে মাঝে ধরা দেয়। শিক্ষাদীক্ষাহীন গ্রাম্য নারীদের কন্ঠ থেকে আপনাতে উচ্চারিত হয় ওদের জীবনের নানান অনুসঙ্গ। বিছানা বা চাটাই নিয়ে প্রসঙ্গ কাব্য।
বিছানা দিলাম যেমন তেমন
বালিশ দিমু না
দমকার বিছানা
বিছাই দিলে বেজার হইও না।

নানান প্রতিকূলতার মাঝেও চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত নারীরা নিত্য স্মরণ করে তার সৃষ্টিকর্তাকে। সকল আপদে বিপদে সৃষ্টিকর্তাই একমাত্র ভরসা।
মাছে করে পানির আশা
পঙ্খী করে ডালের আশা।
আমি করি কিসের আশা?
আমি করি মাওলার আশা।

সোহাগ ভালবাসা রাগ অনুরাগে নিজের পছন্দের মানুষকে আগলে রাখে। তার জন্য সব কিছু উজাড় করে দেয়।
যার লাই যার হরান কান্দে
উদার করি ভাত রান্দে।

ঋণ গ্রহণ করতে নারীদের পড়তে হয় নানান বিড়ম্বনার মধ্যে। এছাড়াও অযাচিত ঋণের কুফল সম্পর্কেও ওদের অজানা নয়। দুর্ভোগের কথা কাব্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়-

হাঁইটতে হাঁইটতে নালা
খাইতে খাইতে গলা।

বর্ষাকালে মাটি জায়গা মত থাকেনা। ধুয়ে চলে যায়। মানুষের আশাগুলোও বিলীন হয়ে যায়।

আল্লা নেয় তোড়ে
বান্দার আশা গড়ে (নালা নর্দমা)।


প্রয়োজনের সময় সকল অনুভূতি বিসর্জন দিতে হয় তাদের

গিন (ঘৃণা) হালাইছি গড়ে (নালা নর্দমা)
ভাত হালাইছি নড়ে (নাড়ীতে)।





প্রিয় মানুষ প্রিয় মুখ যখন দূরে চলে যায়। চলে যায় মনের আড়ালে। হঠাৎ করে যখন এসে কখনো দেখা দেয়, অভিযোগের সুরে বলে-

দিন গেল কাল গেলো
উক্কুৎ (হঠাৎ) করি মনে পড়লো।
গবেষণার গতিময়তা :

গবেষণার ছক বাঁধা হয়েছিলো মাত্র ৬ মাসের জন্য। কাজ করতে গিয়ে কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, যে এটি ঠিক গতানুগতিক গবেষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। একটি সুদূর প্রসারী কর্মসূচীতে এটিকে সংযোজন করতে হবে। গবেষণার একদিকে যেমন রয়েছে চাটাই শিল্পে দরিদ্র নারীদের সামাজিক পরিবর্তনের ভাবনা তেমনি এই সম্ভাবনাময় উপেতি একটি গ্রামীণ শিল্পের প্রসারের রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। যার অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে অসীম। তাই এ বিষয়ে গবেষণা টিমটিও গভীর আগ্রহে ও উৎসুক্য নিয়ে নিরলস কাজ করে গেছে। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা এবং দেশাত্ববোধ এর প্রধান অবলম্বন।

টেবিল নং-২
জেলা- নোয়াখালী, উপজেলা- সদর।

এনিমেটরদের নাম ইউনিয়ন গ্রামের নাম বাড়ীর নাম অংশগ্রহণকারী নারীর সংখ্যা পরিবারের সংখ্যা
আনোয়ারা বেগম (আরজু) ৭নং এওজবালিয়া এওজবালিয়া আকরাম খাঁ মেম্বারের বাড়ী ৩০জন ২২টি
খালেদা আক্তার (লাবনী) ৭নং এওজবালিয়া পূর্ব এওজবালিয়া হাবিল খান দপ্তরী বাড়ী ২৫জন ১০টি
মারজাহান সুলতানা (মার্জু) ৭নং এওজবালিয়া শান্তিনগর আবুল খায়ের মিয়ার বাড়ী ২৫জন ১৬টি
শাহানা আক্তার (শাহীন) ৮নং কালাদরাপ রাহামুড়ী তালুক দাঁড়ী ব্যাপারী জুম্মারাগো বাড়ী ৩০জন ১৩টি
নাছির উদ্দিন শাহ্ (নয়ন) ৮নং কালাদরাপ পশ্চিম বারাহীপুর রুহুল আমিনের বাড়ী (আরাফাত চাটাই প্রকল্প) ২৫জন ১০টি


যেসব নারীরা চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত :

গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্নবিত্ত পরিবারের একদল তৃণমূল নারী মূলতঃ এ চাটাই শিল্পের ধারক ও বাহক। দৈনন্দিন জীবনের বেঁচে যাওয়া সময়টুকুকে তারা ব্যয় করেন চাটাই বুননের কাজে। চাটাই তৈরীর কাজ তাদের জন্য খুব একটা কঠিন না হলেও বেশ পরিশ্রমের ও সময় সাপে। এ সব নারীরা ঘর সংসার সামলানোর পরেও পরিবারের বাড়তি কিছু রোজগারের প্রত্যাশায় হোগলা পাতার নান্দনিক রূপ দিয়ে তৈরী করেন চাটাই শিল্প। এখানকার নারীরা তাদে পূর্ব পুরুষ থেকে প্রাপ্ত পেশাটিকে টিকিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। কোনো রকম প্রশিণ ছাড়াই তারা কাজগুলো শিখেছেন বংশ পরম্পরায়।


চাটাই শিল্পীদের আর্থসামাজিক অবস্থা :

চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত নারীরা বেশীর ভাগ েেত্র দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত। অনেকের নূন আনতে পান্তা ফুরায়। একটি মানুষের বেঁচে থাকার যে পাঁচটি মৌলিক অধিকার রয়েছে তা আদৌ এদের জীবনে অর্জিত হচ্ছে কি কিনা এ নিয়ে তাদের মাথা ব্যাথাও নেই। এদের বেশীর ভাগই অর্থনৈতিক দৈন্যতার কারণে উপযুক্ত শিা ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত। বঞ্চিত স্বাস্থ্য সেবা থেকে। নানা রকম কুসংস্কার ও নিজস্ব ধ্যান-ধারণাকে মনের মাঝে পোষণ করে আছেন এরা। গবেষণার মাধ্যমে তারা তাদের নানান সমস্যাগুলো নিজেরাই চিহ্নিত করতে পেরেছেন। এ সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণকল্পে বিভিন্ন পর্যায়ে মতবিণিময় কালে তাদের মেধা ও মননশীলতার পরিচ্ছন্ন একটি দিক প্রকাশ পায়। বোঝা যায় উপযুক্ত শিা পেলে এরা নিজেদেরকে নুতন ভাবে আবিষ্কার করার সুযোগ পাবে।

শিক্ষা ব্যবস্থা :

এক সময় নারী শিার েেত্র এরা রণশীল মনোভাব পোষণ করলেও বর্তমান যুগের বিবর্তনের এ কালকে তারা অস্বীকার করছে না। কিন্তু দারিদ্র .এদের শিার সু-কোমল বৃত্তিকে দাবিয়ে রেখেছে। তবে এ বিষয়ে তাদের ইচ্ছা শক্তিরও বিকাশ ঘটেনি। আবার কেউ কেউ অভাবের দোহাইকে প্রশ্রয় না দিয়ে তাদের ছেলে মেয়েদেরকে ক্রমশ স্কুলগামী করে তুলেছে। তারা বুঝতে শিখেছে শুধু অর্থ নয় ভাগ্য উন্নয়নের জন্য শিক্ষারও প্রয়োজন রয়েছে।

চিকিৎসা / স্বাস্থ্য সেবা :

এ এলাকার নারীদের অনেকেরই পুষ্টিহীনতায় ভরা জীর্ণশীর্ণ দেহ। অনেকেই ভুগছেন নানা রোগ শোকে। এর কারণ হিসাবে তারা তাদের নিত্য দিনের অভাব অনটনকে দায়ী করেছেন। দারিদ্র তাদেরকে যেমনি আবদ্ধ করে রেখেছে তেমনি আবদ্ধ করেছে রোগ বালাই। এখানকার এ জনগোষ্ঠীর জন্য এখানে নেই কোন চিকিৎসা কেন্দ্র। রোগ বালাই হলে তাদেরকে হতে হয় শহরমূখী। কিন্তু স্বল্প আয়ের এ মানুষগুলোর পে শহরে এসে ব্যয় বহুল চিকিৎসা গ্রহণ করা কোন রকম সম্ভব নয়। এ অবস্থায় তারা শরণাপন্ন হয় সনাতনী চিকিৎসা ব্যবস্থার। অর্থাৎ বাধ্য হয়ে তাদেরকে নির্ভর করতে হয় ঝাড় ফুঁক সহ নানা রকম কবিরাজি চিকিৎসায়। এ প্রসঙ্গে আলোচনা কালে এখানকার বয়স্ক জনেরা মনে করেন তাদের সময় চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকলেও এখনকার প্রজন্মের জন্য এখানে চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে উঠা খুবই জরুরী। বিয়ের পর থেকে সোমেনা খাতুন (৬০) চাটাই তৈরী করে আসছেন, বলেন, ‘‘বাবারে আঙ্গো দিন তো হারই গেছে অনগার হোলাহাইনের লাইতো এক্কান ডাক্তারখানা দরকার।’’ এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে স্থানীয় প্রতিনিধি সহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, এখানকার স্থানীয় কয়েকটি সমস্যার মধ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা প্রধান একটি সমস্যা। এতগুলো জনগোষ্ঠীর জন্য এখানে সরকারী বেসরকারীভাবে আজো গড়ে উঠেনি কোন স্বাস্থ্য কেন্দ্র।


টেবিল নং-৩
চাটাই শিল্পের নারীদের নিজেদের সম্পর্কে ধারণা ঃ


 আমরা সবাই চাটাই বানাতে পারি।
 বাচ্চা লালন পালন, নামায কালাম পড়া।
 গান গাওয়া, বিয়ের গান গাওয়া ইত্যাদিতে অভিজ্ঞ।
 সেলাই করতে পারি।
 নাচতে জানি।
 কুটির শিল্পের কাজ জানি।

বিনোদন :

একজন মানুষের বেঁচে থাকার েেত্র বিনোদন ব্যবস্থা একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। বর্তমান মিডিয়ার যুগে বিনোদনের নানা ব্যবস্থা থাকলেও এর কোনটিই এই সব তৃণমূল মানুষের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেনি। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোথাও কোথাও দু’একটি টেলিভিশন থাকলেও এটি পর্যাপ্ত নয়। কারণ রণশীল সমাজ ও পারিবারিক ব্যবস্থায় নারীদের পে লোকালয়ে গিয়ে বিনোদন উপভোগ করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। তাই তারা নিজেদের মধ্যে গল্প-গুজব, হাসি-ঠাট্টা করে সময় কাটায়। তবে এই কথা সত্য যে, গ্রামীণ এমন কিছু সংস্কৃতি আছে যা অনেক পুরনো হলেও তা এদের আনন্দ দিয়ে থাকে। যেমন রেডিও’র গান, ক্যাসেটের গান, বিয়ের গান, জারী গান, শ্লোক, পুঁথি ইত্যাদি।

টেবিল নং-৪
পুরুষদের সম্পর্কে নারীদের ধারণা :


 পুরুষ উপার্জন করে।
 বাজার করে
 শক্তি বেশি।
 সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
 সংসারের ভালোমন্দ দেখে।
 সন্তান জন্মদানে সহায়ক ভূমিকা পালন করে, বাবা হয়।


হোগলা পাতার চাষ পদ্ধতি :

এ অঞ্চলে কবে কখন হোগলা পাতার উৎপত্তি হয় তার কোন সঠিক তথ্য স্থানীয় জনগণ জানাতে পারেনি। এ সম্পর্কিত কোন তথ্য স্থানীয় কৃষি বিভাগও জানাতে পারেনি। হোগলা পাতা এক ইঞ্চি ব্যাস বিশিষ্ট দশ বার ফুট লম্বা, চির সবুজ তৃণ জাতীয় উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম ঞণচঐঅ ঊখঊচঐঅঘঞঊঘঅ.

প্রাকৃতিকভাবে এ হোগলা পাতার বন গড়ে উঠেছে। সাগর থেকে এক সময় চর জেগে উঠে। চরগুলো তখনো থাকে নীচু। এ অবস্থায় জোয়ারের পানিতে ভেসে আসে হোগলার বীজ। এ ভাবে নতুন হোগলার ঝাড় সৃষ্টির মাধ্যমে এ বনের উৎপত্তি হয়েছে। নদী বা খালের পাড়ে এবং পলিমাটি সমৃদ্ধ ভেজা মাটিতে হোগলা গাছ আপনাতেই জন্মায়। হোগলা পাতা দেখতে অনেকটা ত্রিকোণাকৃতির। পাতা উৎপাদনের জন্য কোন সেচ ব্যবস্থা নিড়ানী আগাছা দমন বা কীট নাশকের প্রয়োগের প্রয়োজন হয়না। এর বংশ বৃদ্ধি সাধারণতঃ বীজ বা গাছের মূলের সাহায্যে হয়ে থাকে।
হোগলা পাতা সাধারণতঃ কার্তিক অগ্রাহায়ন মাসে কাটা হয়। কাটার পর পাতাগুলো রোদে শুকিয়ে চাটাই বুননের উপযোগী করে তোলা হয়। হোগলা পাতা সাধারণতঃ দুই প্রকারের।

১. আউশ পাতা।
২. শাইল পাতা।
রোদে শুকানোর পর পাতাগুলো হলুদ আকার ধারণ করে। কার্তিক অগ্রহায়ন মাস ছাড়াও আষাঢ় শ্রাবণ মাসে একবার পাতাগুলো কাটা হয় যাতে অকেজো পাতাগুলো বাদ হয়ে নতুন পাতা গজায়।

প্রক্রিয়াজাতকরণ :
রোদে শুকানোর পর পাতাগুলোকে ধারালো ছুরি দিয়ে লম্বালম্বী ভাবে দুইভাগ করা হয়। দুইটি অংশ দিয়ে চাটাই তৈরী করা যায়। মাঝখান থেকে চিকন সুতার ন্যায় একটি আবরণ বের করা হয়। যা দিয়ে সিকা, দড়ি ইত্যাদি তৈরী করা যায়।

উৎপাদিত পণ্য :

হোগলা পাতা দিয়ে চাটাই তৈরীর পাশাপাশি হাত পাখা, ঝুড়ি, সিকা, বিড়া (স্থানীয় ভাষায় হোঁচ্ছা) দড়ি, টুকরি, পানের বাটা ইত্যাদি গৃহস্থালির ব্যবহার্য্য পণ্য তৈরী করা হয়।

ব্যবহার বিধি :

হোগলা পাতার চাটাই মুসলমানদের মসজিদ, মক্তব, মাদ্রাসা, বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া কোরবানের পশু জবাই করার পর মাংস কাটার কাজে ব্যবহার করা হয়। ব্যবহার করা হয় মৃত ব্যক্তির দেহ মোড়ানোর কাজে। শুধু যে মুসলমানরা ব্যবহার করে তা নয়, বিভিন্ন মন্দির ও গীর্জায় হোগলা পাতার চাটাই ব্যবহার করা হয়। তাছাড়াও নতুন দালান নির্মাণের এবং ছাদ ঢালাইয়ের সময় ব্যবহার করা হয়। ঘরের শোভা বর্ধনের ল্েয বিভিন্ন নকশা খচিত করে চাটাই ব্যবহার করা হয়। গ্রামাঞ্চলে উননের ধোঁয়া থেকে রা পাওয়ার জন্য ঘরের দমদমা (সিলিং) হিসাবে ব্যবহার করা হয়।




প্রাপ্তীর স্থান :

নোয়াখালীর সদর থানাধীন খলিফার হাট, বাঁধের হাট, ওদার হাট, এওজবালিয়া, বিনোদপুর এসব এলাকায় সাধারণতঃ হোগলা পাতা ব্যাপক হারে জন্মে। এ এলাকাগুলো হোগলা পাতা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন উৎপাদিত পণ্যের প্রাপ্তীর স্থান হিসাবে চিহ্নিত। এছাড়াও নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ উপকূলে হোগলা পাতা আপনাতেই জন্মে।

এ অঞ্চলের হোগলা পাতা শিল্পের প্রধান কেন্দ্রটি খলিফার হাটে গড়ে উঠেছে। সপ্তাহে রবি ও বুধবার এখানে হাট বসে। সে হাটের বিরাট একটি স্থান জুড়ে রয়েছে শুধুমাত্র হোগলা পাতা বেচা কেনার জন্য। এ ব্যবসা গড়ে উঠেছে কয়েকটি শ্রেণীর মধ্যে। একদল মাঠে গিয়ে গৃহস্থ কৃষকদের কাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করে। সে পাতা দিয়ে আঁটি বাঁধা হয়। পাতার মান অনুযায়ী আলাদা আলাদা করে আঁটি বাঁধা হয়। মান অনুযায়ী প্রতিটি আঁটির দামও হেরফের হয়। এবং ওসব আঁটির পাতা দিয়ে তৈরী চাটাইর দামেও হেরফের থাকে। সেগুলো চাটাই তৈরী করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় বিভিন্ন নারীদের কাছে। বেচা কেনার আর একটি মাধ্যম হচ্ছে ব্যবসায়ীরা হোগলা বনের মালিক থেকে বিভিন্ন মেয়াদে পুরো হোগলা বন কিনে নেয়। গ্রামের নারীরাই সাধারণতঃ চাটাই তৈরী করেন। সে চাটাই ফড়িয়ারা সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চালানের উদ্দেশ্যে জমা করে এবং তারাই এ চাটাই দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করে।

গবেষণা কালে জানা গেছে প্রতি হাটে এখান থেকে প্রায় দু’ থেকে তিন ল টাকার চাটাই ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ফরিদপুর সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি করা হয়। এ নিয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয় বছরে এর পরিমাণ প্রায় কোটি টাকার উপরে। হরিনারায়ণপুর রেল ষ্টেশন থেকেই সাধারণতঃ এগুলো ট্রেনে বোঝাই হয়।

বাজারজাত করণে ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য :

চাটাই শিল্পে বাজারজাত করণ তথা ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তিতে প্রধান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী হল ফড়িযারা। স্থানীয়ভাবে যারা দালাল নামে পরিচিত। চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত একজন নারী হোগলা পাতা কেনা থেকে শুরু করে যে পরিমাণ কায়িক শ্রম দিয়ে একটি চাটাই তৈরী করে, এ ফড়িয়াদের কারণে তারা তাদের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। দেখা যায় একটা চাটাই তৈরী করতে প্রায় ৩০ টাকার পাতা কিনতে হয়। তার সাথে আছে তৈরী করা পর্যন্ত পুরো একদিনের শ্রম। শ্রমের বাজারের যার মূল্য সর্ব নিু ৭৫ টাকা। কিন্তু দেখা যায় এভাবে তৈরীকৃত চাটাই যখন বাজারে আসে তখন ফড়িয়ারা এর দাম ধরে ২০ থেকে ৩০ টাকা। এ অবস্থায় দেখা যায় বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ফড়িয়ারাই দাম নির্ধারণ করে থাকে। ব্যাপারটি যে কারিগররা উপলব্ধি করতে পারে না তা নয়। কিন্তু অর্থনৈতিক টানা পোড়নের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে তারা এ সমস্যা গুলোকে স্বীকার করে নিচ্ছে। পক্ষান্তরে লাভবান হচ্ছে ফড়িয়ারা।



ফড়িয়াদের কাছ থেকে কিভাবে উত্তরণ করা যায় :

চাটাই শিল্পটি মূলতঃ একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা পেলে চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত নারীরা অর্থনৈতিক মুক্তিলাভ করবে। যদি তারা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করণের একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে তাহলে ফড়িয়া নামধারীর দুষ্ট চক্রের হাত থেকে রা পেতে পারে। এতে করে তারা বিক্রয়মূল্য সরাসরি গ্রহণ করতে পারবে। তাদের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী বাজারজাত করণের লে বেসরকারী সংস্থা এন আর ডি এস (নোয়াখালী রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি) নোয়াখালীতে কুটির শিল্পীদের তৈরী বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীর একটি প্রকল্প রয়েছে। তাঁরা হোগলা পাতা দিয়ে উৎপাদিত পণ্য দেশে বিদেশে বাজার করতে আগ্রহী। শুধু হোগলা পাতা দিয়েই এ এলাকায় রপ্তানীমূখী কুটির শিল্প গড়ে উঠতে পারে। শহর কেন্দ্রীক এমন কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যাদের পে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারী পুরুষদের সাথে যোগাযোগ রা করা বহুলাংশে সম্ভব হয়না। এ ক্ষেত্রে এ ধরণের গবেষণার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা যদি অনুঘটক হয়ে এদের তৈরী উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করণের সহযোগিতা করে তাহলে তারা বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠবেন এবং ফড়িয়াদের কাছ থেকে নিজেদেরকে রা করতে পারবেন। এভাবে নিজেরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন।

একজন নারী একটি চাটাই তৈরী করে বাড়ীর পুরুষ কর্তা অথবা কোন কিশোর কিশোরী কিংবা শিশুদেরকে দিয়ে বাজারে পাঠায়। সে শিশু কিশোর বা কিশোরীটি সেজে গুজে চাটাই নিয়ে বাজারে গিয়ে দাঁড়ায় তখনও সে জানেনা এ চাটাইটির ন্যায্য মূল্য কত আর এ না জানার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ফড়িয়ারা কম দামে চাটাইটি কিনে নেয়। প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায় শিশু কিশোররা চাটাই বিক্রি করার জন্য বাজারে আসে এবং তারাই আবার বাজার থেকে হোগলা পাতার আঁটি কিনে নিয়ে যায়। এই শিশু কিশোররা অনেকেই বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে। কিন্তু হাট বাজারের দিন তারা স্কুলে না গিয়ে এই চাটাই বিক্রির কাজে ব্যস্ত থাকে। সে সঙ্গে তারা বাড়ীর জন্য বাজার সদাই করে নিয়ে যায়। এদিকে এ সমস্ত হাট বাজার গুলোতে বিশেষ করে ডানিডা সহযোগিতায় নারীদের জন্য একটি পাকা ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিলো এখানে এসে নারীরা তাদের পণ্য বেচাকেনা করবে। কিন্তু এ সেড গুলো প্রায় ফাঁকা থাকে। খলিফার হাটে বাজার কটি ও স্থানীয় একটি সংস্থার উদ্যোগে চাটাই তৈরীর কাজে জড়িত নারীদের জন্য আলাদা একটি প্লটের ব্যবস্থা থাকলেও সমাজের রণশীলতার বেড়াজালের কারণে নারীরা বাজার মুখো হয়না। আর হয়না বলেই বঞ্চিত হয় ন্যায্য মূল্য থেকে। এ ক্ষেত্রে নারীরা নিজেরা সংঘবদ্ধ হয়ে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। যেখানে ফড়িয়ারা ছাড়া পাইকারী ব্যবসায়ীরা এসে তাদের কাছ থেকে চাটাই ক্রয় করবে। এ ভাবে নারীদের নিজেদের নিয়ন্ত্রনে একটি বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।

চাটাই শিল্পী নারীদের ধ্যান ধারণা ও চিন্তা চেতনা :

চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত নারীরা অজ্ঞতা, অসচেতনতা, অশিক্ষা, ধর্মীয় গোড়ামী ইত্যাদির কারণে বিভিন্ন সনাতনী ধ্যান-ধারণা পোষণ করে আসছে। তবে তাদের মধ্যে জানার প্রবল ইচ্ছাশক্তি সম্পূর্ণভাবে বিরাজমান। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে বিভিন্ন জন বিভিন্ন মত প্রকাশ করেন। তাঁরা মনে করেন, মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য এই যে, মানুষের বুদ্ধি, বিবেক আছে, আছে বিবেচনা বোধ। কিন্তু পশু পাখির মধ্যে এ গুণ গুলো সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। মানুষ হিসাবে তাদের অধিকার সম্পর্কে চিন্তাগুলো খুব স্পষ্ট নয়। তাদের মতে একজন মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার জন্য সরকার কর্তৃক সুযোগ সুবিধা গুলো হ্েচ্ছ তার অধিকার।

কাজের মূল্যায়ন :

নিজেদের কাজের মূল্যায়নের ব্যাপারটি নিয়ে এসব নারীরা চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। একজন নারী শুধু কাজই করে যাবে, এমন একটি ধারণা পোষণ করে আছে তারা। এরা আরো মনে করেন, শুধুমাত্র পুরুষের সেবা করার জন্যই নারী জাতির জন্ম হয়েছে। গবেষণায় তারা উপলব্ধি করেন যে, কাজের মূল্যায়ন পাওয়া তাদের একটি ন্যায্য অধিকার। গ্রামের কয়েকজন পুরুষের সাথে নারীদের কাজের মূল্যায়ন সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করলে তারা স্বীকার করেন যে, নারীদের কাজের মূল্যায়ন করা উচিত। তারা বুঝতে শিখেছে পরিবারের উন্নয়নে নারীরাও ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। তোফায়েল আহমদ (৬০) পেশায় কৃষক, তিনি বলেন, ‘মায়েরা বেশি কাম কইত্তো, অন দেই হোলা মাইয়ার মায়েও বেশি কাম করে। আসলে ঘরের মইধ্যে মাইয়াগো কামও বেশি।’ তাঁর মতে, চাটাই বিক্রির সব টাকা চাটাই বুননকারীকেই দিতে হবে। কারণ এই টাকার হক তারই সবচেয়ে বেশি। প্রতি বছর এই এলাকায় প্রায় ১ কোটি টাকার চাটাই বেচাকেনা হয়।

চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত নারীদের ভাগ্য উন্নয়নে তারা কিভাবে স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে, ফড়িয়াদের কাছ থেকে উত্তরণের পথ কিভাবে তারা অধিকার করতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে তারা কিভাবে স্বয়ং সম্পূর্ণতা লাভ করতে পারে, শিশু ও বয়স্ক শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের ভাবনা ও করণীয় কি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলাপ হয় স্থানীয় প্রতিনিধি, বিভিন্ন পেশার লোক, গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত নারী ও পুরুষের সাথে।

উল্লেখিত বিষয় নিয়ে কালাদরাপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ার উল্যা বলেন, ‘এ এলাকায় শতকরা ৮০ জন লোকই মূলতঃ চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত। এটি এখানে একদিকে যেমন এলাকার ঐতিহ্য অন্যদিকে এখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের আয়ের প্রধান উৎস।’ তিনি আরো বলেন, ‘এখানে বুধ ও রবিবারে সাধারণতঃ হাট বসে। তখন ছোট ছোট কিশোর কিশোরীরা মাথায় করে চাটাই নিয়ে আসে। এ দৃশ্য আমার কাছে খুব ভাল লাগে। দুঃখ হয় যখন দেখি চাটাই শিল্পীরা তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়। সারা দিন কষ্ট করে বাড়ীর মহিলারা চাটাই তৈরী করে অথচ বাজারে গেলে তারা পরিশ্রম অনুযায়ী মূল্য পায়না, দালালরা (ফড়িয়া) তাদের ঠকিয়ে ল ল টাকার মালিক বনে যাচ্ছে। আর চাটাই শিল্পীদের ভাগ্যের পরিবর্তন তো হচ্ছেনা উপরন্তু তারা ক্রমশঃ দরিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত হচ্ছে।’ ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্যমুক্ত হয়ে তারা কিভাবে উত্তরণ ঘটাতে পারে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত যেসব নারী পুরুষ জীবিকা অর্জন করছে তারা যদি নিজেদেরকে সংঘবদ্ধ করে (অনেকটা সমিতির মত) নিজেদের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী সরাসরি গ্রাহকদের হাতে পৌঁছে দিতে পারে তাহলে তারা ন্যায্য মূল্য তো পাবেই এমনকি এ শিল্পটি দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রসার লাভ করবে। যেসব জায়গায় হোগলা পাতা উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা রয়েছে সেসব জায়গায় কেউ যদি মধ্যস্থতা করে তাহলে তাদের ভাগ্যোন্নয়ন হওয়া তেমন কোন ব্যাপারই না।’



তিনি আরো বলেন, ‘ এ এলাকায় যেসব এনজিও কাজ করে, তারা এদের উপরে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিতে ব্যস্ত অথচ তারা যদি এদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে তাহলে এরা হোগলা পাতা দিয়ে শুধু চাটাই নয়, আরো নতুন নতুন সামগ্রী তৈরী করে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারে।’

কালাদরাপ ইউনিয়নের কমিশনার আবুল কালাম চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত নারী পুরুষদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘ এ শিল্পের সাথে জড়িত নারীদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক, এখানে যারা চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত তাদের পেশাটা মার খাচ্ছে মূলতঃ দালালদের কারণে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ফড়িয়াদের কাছ থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে চাটাই শিল্পীদের একটি সমিতি করতে হবে।’ আরাফাত চাটাই প্রকল্পের মালিক রুহুল আমিন বলেন, ‘আমি চেষ্টা করেছি এই প্রকল্পের মাধ্যমে এখানকার চাটাই শিল্পীদের একত্রিত করে তাদের তৈরী পণ্য সামগ্রী নিজ উদ্যোগে বাজারজাত করার জন্য। কিন্তু প্রয়োজনীয় পুঁজি ও সহযোগিতার অভাবে আমি ব্যর্থ হয়েছি, এটা সফল হলে ফড়িয়াদের কাছে আর যেতে হতোনা।’

গবেষণার মূল ফোকাস :

নোয়াখালী সদর থানাধীন দণি পশ্চিম অঞ্চলের চরমটুয়া, ৭নং এওজবালিয়া, কালাদরাপ, বিনোদপুর প্রভৃতি ইউনিয়নের প্রায় ১ ল লোক চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত। যার মধ্যে চার ভাগের তিন ভাগই নারী। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক নারীরা আর্থ-সামাজিকক জীবন যাত্রায় সকল ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।

আত্মসম্মানবোধ, নিরাপত্তাহীনতা, শিক্ষাদীক্ষায়, মত প্রকাশে, চিকিৎসাক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় এমনকি বেঁচে থাকার জন্য যে খাদ্যের প্রয়োজন সেখানেও তারা বঞ্চিত হচ্ছে। প্রযুক্তি নির্ভর পণ্য মানুষের জীবনযাত্রাকে যান্ত্রিক করে তুলছে। মুক্ত বাজার ব্যবস্থায় উৎপন্ন পণ্যের দিনদিন প্রসার ঘটছে। অন্যদিকে পরিবেশ বান্ধব পণ্য ক্রমশঃ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে নারীদের হাতে বোনা চাটাই অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে। অথচ বিপুলভাবে অবমূল্যায়ন হচ্ছে চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত নারীরা। চরম দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে তারা। তবুও উত্তরাধীকার সূত্রে এই দরিদ্র নারীরাই এই ঐতিহাসিক শিল্পের ধারক ও বাহক। তাদের এই শিল্প চর্চা হাজার বছর ধরে প্রচলিত প্রাকৃতিক বিজ্ঞান মানসিকতার পরিচয় দেয়। এই শিল্পের মাধ্যমে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশকে নতুন করে পরিচিত করে তুলতে পারে। সেই সঙ্গে এই শিল্পের সাথে জড়িত নারীদের জীবন যাত্রার মানোন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।





প্রশিক্ষণ, পূঁজি, বাজারজাতকরণ :

চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত নারীরা চাটাই তৈরীতে অত্যন্ত দক্ষ। এর জন্য তারা কোন প্রশিক্ষণ পায়নি। বংশ পরম্পরায় তারা এ কাজে দক্ষতা অর্জন করেছে। হোগলা পাতা দিয়ে যে অন্যান্য পণ্য বানানো যায় এবং তার অনেক বাজার মূল্য আছে এ বিষয়ে তারা একেবারেই অজ্ঞ। গবেষণায় দেখা গেছে সামান্য প্রশিক্ষণ পেলে এ নারীরা বিভিন্ন সৌখিন দ্রব্য তৈরীতে সম হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে এগুলো রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। সিলেটের পাহাড়ী জনগোষ্ঠি বিশেষ করে খাসিয়ারা এই চাটাই ব্যপক ভাবে ব্যবহার করে। তাদের মধ্যে এর ব্যপক চাহিদা রয়েছে। পান পাতা মোড়ানোর জন্য সাধারনত এগুলো ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া সীমান্তের অপর পাড়ে চাটাই প্রচুর চালান হয়। ঘরের দৈনন্দিন কাজেও খাসিয়াদের মধ্যে চাটাই খুব জনপ্রিয়। নোয়াখালীর এই চাটাই সিলেট হয়ে খাসিয়া পুঞ্জিতে সরবরাহ হয়।

উপকূলীয় অঞ্চলে যেহেতু এই গাছ আপনাতেই জন্মে সুতরাং চাষের জন্য এর একেবারেই খরচ নেই। হোগলা গাছের পাতা পোক্ত হলে মাটির উপর থেকে গোড়া বা মূল রেখে কেটে নিলে তা থেকে আপনাতেই গাছটি আবার জন্ম নেয়। খরা বা বর্ষায় এ গাছের কোন তি হয়না। যে কোন পরিবেশে গাছটি দীর্ঘজীবী। এক শত টাকা মূল্যের একটি চাটাই বুনতে পঁচিশ থেকে ত্রিশ টাকার হোগলা পাতার প্রয়োজন পড়ে। নারীরা ঘরে বসেই দ হাতে প্রতিদিন দুই তিনটি চাটাই বুনতে পারে। প্রতি সপ্তাহে স্থানীয় বাজারে এগুলো বিক্রি করা যায়। এ হিসাবে যে কোন নারী খুবই সামান্য পুঁজি নিয়ে এ কাজটি করতে পারে।






















কেইস্ স্টাডি - ১


জনপি বেগমের জনপ্রিয়তা

মাত্র বার বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় জনপি বেগমের। জনপিদের ছিলো অভাবি সংসার। তার উপর মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়ে যেন সে নিজেই বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছে। জীবন সম্মন্ধে কোনো কিছু বুঝার আগেই বাবা মা বিয়ে দিয়ে দেয় তাকে। এ অবস্থায় শিশু বয়সেই পুতুল খেলা ছেড়ে জনপি চলে যায় শশুর বাড়ির অজানা পরিবেশে। সেখানেও অভাবের সংসার। স্বামী নূরুল আমিন শিক্ষা দীক্ষ হীন বেকার যুবক। গায়ে গতরে খেটেই চলতে হয় তাদের। এ ভাবেই অভাবের ঘানি টেনে চলছিলো তারা। সংসার সম্মদ্ধে অনভিজ্ঞ জনপি। এ অভাবি সংসারের মাঝে একে একে যোগ হয় আরো সাত সাতটি সন্তানের। চোখে মুখে অন্ধকার দেখে জনপি বেগম। নোয়াখালীর সদর উপজেলার পশ্চিমে কালাদরাপ ইউনিয়নের রাহামুড়ি তালু গ্রামে জনপির জরাজীর্ণ কুটির। অভাবের সে সংসার যেন আর চলতে চায়না। অন্ধকার যখন সব কিছু গ্রাস করে নিচ্ছিলো তখন এক কঠিন বাস্তবতার মধ্যে নিজেকে দাঁড় করায় জনপি। এলাকার নারীরা সবদিক দিয়ে পিছিয়ে। এদের উপর রয়েছে সমাজের এক অঘোষিত বিধিনিষেধ। জনপি সে বিধিনিষেধকে অগ্রাহ্য করে নেমে পড়ে নিজ ভাগ্য গড়ার ব্রত নিয়ে।
নোয়াখালীর উপকুলীয় এ অঞ্চলে প্রচুর হোগলা পাতা জন্মে। এখানকার অনেক নারী এই হোগলা পাতা দিয়ে চাটাই বানিয়ে কিছুটা আয় করতে চেষ্টা করে। এলাকার ঐতিহ্য অনুযায়ী জনপি বেগম ছোটকাল থেকেই হোগলা পাতার চাটাই বানিয়ে আসছিলো। জনপি দেখলো দিনরাত কষ্ট করে নারীরা হোগলা পাতার চাটাই বানায়। তারা এতো পরিশ্রম করেও সঠিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। এখানে তৈরী করা হোগলা পাতার চাটাইয়ের সারা দেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে । এই এলাকা থেকে প্রচুর চাটাই দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হয়। এখান থেকে সবচেয়ে বেশী যায় সিলেট অঞ্চলে। এই চাটাই এর বাজারটি নিয়ন্ত্রনে রেখেছে এক দল ফড়িয়া আর দালাল চক্র। তারা প্রতিটি বাজার থেকে কম মূল্যে চাটাই কিনে অধিক মুনাফায় এগুলো বিক্রি করে। জনপি দেখলো ফড়িয়াদের পাশ কাটিয়ে বিভিন্ন বাজারে এগুলো বিক্রি করলে সে আরো বেশী লাভবান হতে পারবে। শুরু হলো জনপির পরিশ্রমের পালা। এ এলাকায় যে সব নারীরা চাটাই বানায়, তারা সাধারনতঃ সংসারের নানান কাজের পরে প্রতিদিন দু একটি করে চাটাই বানিয়ে সাপ্তাহিক হাটে বিক্রি করে। এতে সংসারের টুকটাক খরচ চলে।
গ্রামের নিচু জমিতে সাধারন ভাবে উৎপন্ন হোগলা পাতার উপর অনেকেই জীবিকা নির্ভর করে। হোগলা পাতা সংগ্রহ করতে বা কিনতে যে টাকার প্রয়োজন পড়ে জনপি সে সামান্য টাকাও জোগাড় করতে পারেনা। তাই বলে গ্রামের অসহায় অবলা নারী হয়ে হা- হুতাস করে ঘরে বসেও থাকেনি। প্রথমে পাশের জমির মালিক থেকে বেশী দাম দিয়ে বাকীতে পাতা কিনে চাটাই বনানো শুরু করেন। বুনতে বুনতে সে এ কাজে প্রচুর দ হয়ে উঠেন। দিনরাত পরিশ্রম করে সে প্রতিদিন সর্বোচ্চ সাত আটটি চাটাই তৈরী করতে লাগলো। এতে প্রতি হাটে পঁচিশ থেকে ত্রিশটি চাটাই বিক্রি করতে থাকে। প্রতিটি চাটাই থেকে সে লাভ করে বিশ থেকে পঁচিশ টাকা। এভাবে প্রতি হাটে সে আয় করে সাত শ’ থেকে আট শ’ টাকা। তার বাড়ীর কাছে রয়েছে খলিফার হাট। প্রতি সপ্তাহে এখানে দু’বার হাট বসে। এ বাজার থেকেই প্রতি মাসে আয় হয় চার পাঁচ হাজার টাকা। অভাব যেন আস্তে আস্তে পালাতে থাকে তার ঘর থেকে। এ অবস্থায় তার নিজের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যায়। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় সে এ কাজে অরো বেশী মনোযোগ দিতে থাকে। তার এ কাজ দেখে আসে পাশের মানুষ আরো আগ্রহী হয়ে উঠে । এ কাজ সে শুধু একাই করছেনা আশে পাশের অন্যদেরকেও সম্পৃক্ত করে নিচ্ছে। শুধু চাটাই’র মধ্যে জনপি তার কাজ সীমাবদ্ধ রাখেনি। নানা রকম টুকরি ঝুড়ি ইত্যাদি সে নিজের উদ্ভাবনী মেধা দিয়ে তৈরি করে নিয়েছে। যেগুলো মানুষের সংসারের বিভিন্ন কাজে প্রয়োজন পড়ে। মানুষের কাছেও এগুলোর বেশ চাহিদা রয়েছে। তার এ কাজে স্বামী নুরুল আমিন আস্তে আস্তে সহযোগীতা করতে লাগলো। এক সময় নুরুল আমিন পুরোপুরি ভাবে এ কাজে জড়িয়ে পড়ে। দুজনে এক সঙ্গে কাজ করাতে কাজের গতিও বেড়ে গেলো। আয়ও হতে লাগলো আগের চেয়ে বেশী। ১৯৯৩ সালের দিকে তাঁরা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে পুরো পুরি চাটাই ব্যবসা শুরু করেন। নিজেদের বানানো এবং স্থানীয় বাজার থেকে কেনা চাটাই নিয়ে প্রথমে সিলেটে নিয়ে বিক্রি করেন। এতে প্রচুর লাভ হয়। তবে তারা বলে, এ কাজে লাভ লোকসানও আছে। কারন সময় বুঝে পাতার দাম উঠানামা করে। তখন সাবধানে বেচা বিক্রি করতে হয়। বাজার না বুঝলে লোকশানও গুনতে হয়। জনপি বেগম বলেন,‘আল্লার তান দাড়ি হাতা মাডে হড়ি রইছে, এ গুন দি আঙ্গো রিজিক চলে। এ হাতা দি বেরেন খাটাইলে আঙ্গো অভাব থায়নি ? অর্থাৎ ‘খোদা তালার দান মাঠে পড়ে আছে, এ গুলো দিয়েই আমাদের রিজিক চলে, আমরা যদি মাথা খাটিয়ে এর সদ্ব্যবহার করতে পারি , তাহলে আমাদের কি আর অভাব থাকে’ ? জনপি বেগম বলেন, এ এলাকার প্রায় আশি হাজার মানুষ চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে। এলাকার প্রতিটি বাড়ির প্রতিটি নারী চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত। শিশু কাল থেকেই নারীরা চাটাই তৈরিতে হাতেখড়ি নেয়।
জনপি বেগমের বড় দুই ছেলে এল্যুমিনিয়ামের হাড়ি পাতিলের ব্যবসা করে। জনপি বেগমই তাদের ব্যবসা ধরিয়ে দিয়েছে। এলাকায় জনপি এখন খুব জনপ্রিয়। বুদ্ধি পরামর্শের জন্য সবাই তার কাছে ছুটে আসে। জনপি বেগমকে এখন এলাকার সবাই ডাকে ‘জনপ্রিয়’ বেগম । সবারমুখে এ নাম তিনিও খুব খুশি।




কেইস্ স্টাডি - ২

* জাকেরা বেগমের আশা ভঙ্গের গল্প
একটি সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখতো জাকেরা বেগম (২৫)। ভালো উপার্জন করবে তার স্বামী। সংসারকে নিজ হাতে গড়ে তুলবে সে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর সৃষ্টিকর্তা তার বিপরিত ভাগ্য নির্ধারণ করে রাখে। একদিন হঠাৎ করেই বিয়ে হয়ে যায় জাকেরার। বিয়ের পর কিছু দিন বাপের বাড়িতে ছিলো জাকেরা। কয়দিন যেতে না যেতেই স্বামীর বাড়ি গিয়ে জাকেরা জানতে পারে, স্বামী নূরুল আমিন এর আগে আর এক বিয়ে করেছে। শুধু তাই নয়, সেই ঘরে তিন তিনটি সন্তানও রয়েছ। কিন্তু এ বিষয়টি জাকেরার অভিভাবকরা কেউ জানতোনা। রাগে দুঃখে অপমানে জাকেরা নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিলো। তার সুন্দর সংসারের স্বপ্ন নিমেষে খান খান করে ভেঙ্গে পড়লো। আর দেরি নাকরে জাকেরা ফিরে আসে বাবার বাড়িতে। নতুন করে স্বপ্ন দেখারও সাহস করেনি আর। অনুন্যপায় হয়ে নিজের বিয়ের ভাগ্যকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। সিদ্ধান্ত নেয় বাবার বাড়ি থেকে আর ফিরে যাবে না সে। এর পর স্বামীর বাড়িতে আর পা বাড়ায়নি। বাবার বড়িতে থেকেও কি করবে কিছুই বুঝতে পারেনা। কিছুদিন পর স্বামী তাকে নিতে আসে। কিন্ত জাকেরা তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। মনে প্রাণে দেহে যখন ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হলো তখন চাটাই পাতার মধ্যে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে জাকেরা। ছোট কাল থেকে হাতে খড়ি নেয়া চাটাই বুনোনের কাজে আবার নেমে পড়লো সে। মাঝে মাঝে স্বামী এসে দেখা করে যায়। বাবার বাড়িতে বসে স্বামীর কাছ থেকে নিজের খরচের টাকা নিতে অপমান বোধ করলো সে। ইতিমধ্যে তিন তিনটি সন্তান আসে তার কোলে। এদের সবার ভরন পোষন খরচাদি সে নিজেই বহন করে। এক মাত্র চাটাই বানিয়েই সে এগুলো উপার্জন করছে। এর জন্য তাকে দিন রাত করতে হচ্ছে কঠোর পরিশ্রম। জাকেরা জানায় প্রতি হাটে ফড়িয়ারা তার কাছ থেকে চাটাই কিনে নিয়ে যায়। সরাসরি বিক্রি করতে পারলে তার অরো লাভ থাকতো। এতো পশ্রিম করেও জাকেরা খুব সন্তুষ্ট । কারন সে মনে করে সামান্য করে হলেও চাটাই বানিয়ে সে আজ একজন আত্ম নির্ভরশীল নারী। অন্যের দ্বারস্থ না হয়ে নিজ সম্মান নিয়ে সমাজে মাথা তুলে চলছে। তার আগামী স্বপ্ন তিনটি সন্তানকে পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করে গড়ে তুলবে।

কেইস্ স্টাডি - ৩

• হাজেরা খাতুনের দিন কাল

একটুও সময় নেই হাজেরা খাতুনের। ৬০ বছর বয়সেও মুক্তি নেই তার। বৃদ্ধ বয়সে এসে তার জীবনটা অষ্টপৃষ্টে মিশে গেল হোগলা পাতার সাথে। কাজের সময় কারো সাথে মাথা তুলে কথা বলতে চায়না বিবি হাজেরা । কথা বললে তার সময় নষ্ট হবে। চাটাই বুনতে তি হয়ে যেতে পারে। হাজরা তিন সন্তানের জননী। স্বামী মৃত আবদুল লতিফ চাটাই ব্যবসায়ী ছিলেন। চার বছর আগে এক অসুখে মারা যান। স্বামী মারা যাওয়ার পর সংসারে এক মহা দুর্যোগ নেমে আসে। এ দুর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য বৃদ্ধ বয়সে চাটাই বুননের কাজ শুরু করতে হয় তাঁকে। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে হাজেরা খাতুন জনান, যত দিন বেঁচে থাকি ততদিন আমাকে কষ্ট করে যেতে হবে। সংসারে স্বামী না থাকলে নারীদের জীবন আঁধার’। বড় ছেলে বিয়ে করে বৌ-নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। আর এক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিজের কাছে রাখলেন। এখন মা আর মেয়ে মিলে চাটাই তৈরি করেন। হাজেরা সপ্তাহে দুই দিন চাটাই নিয়ে খলিফার হাট বাজারে যান। চাটাই বিক্রি করে আবার পাতার আঁটি কিনে আনেন। তিন দিনে হাজেরার ৫০ টাকার মত লাভ হয়। তিন দিনে এ টাকায় কিছুই হয়না। অবশ্য মেয়ের জামাই মাঝে মাঝে সাহায্য করে। চৈত্র বৈশাখ মাসে হাজেরার বেশি কষ্ট হয়। ঐ সময় আবহাওয়ার জন্য চাটাই কম তৈরি করতে পারে। সে সময় তাঁর আয় কম হয় তাই না খেয়ে থাকতে হয় দিনের পর দিন। কয়েক দিন আগে মেম্বারের কাছে গিয়েছিলেন ভি,জি,এফ কার্ড করার জন্য। কিন্তু মেম্বার তাকে কার্ড করতে দেন নি , তার ছেলে আছে বলে। এ দিকে বিধবা ভাতা বয়স্ক ভাতা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে হাজেরা খাতুন।

কেইস্ স্টাডি - ৪

নূর নেছার হারিয়ে যাওয়া শৈশব

চাটাই শিল্পী নুর নেছা (২০)। মুখের দিকে তাকালে মনে হয় যেন জীবনের সব চেয়ে বড় কিছু হারিয়ে ফেলেছে। হাজার প্রতিকুলতার মাঝেও নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে এক কঠিন বাস্তবতায় । বিয়ের পর থেকেই চাটাই বুননের কাজে লেগে যায়। চাটাই বুনে আর মনের দুঃখে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায়। নূর নেছা বলে,‘ আমার মা আমাকে বিয়ে দেয় ইট ভাটায় কাজ করে এমন এক ছেলের সাথে। যখন বিয়ে হয় তখন বয়স ছিলো ১১ বছর’। বিয়ের মর্ম সে সময় সে কিছুই জানতোনা। শশুরালয় গিয়ে দেখে বৃদ্ধ শশুর আর শাশুড়ীর সাথে এক ননদিনী আছে। সে জানত না এদেরকে কি করতে হবে কিংবা স্বামী সহ সকলকে সেবা দিতে হবে কি ভাবে। এ সময় শাশুড়ী তাকে জানায় কাজ না শিখে বাবার বাড়ী থেকে আর আসবে না। তখন নুর নেছা বাবার বাড়ীতে এসে আর শশুরালয় যায়নি। নুর নেছার মা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে মনে হয় শাস্তি পেলেন। কারণ তার বাবা নেই মা বৃদ্ধ মানুষ। কখন কোন মূহুর্তে মারা যায়, সব সময় সে ভয় তার মধ্যে কাজ করে। নূর নেছার স্বামী তাকে অনেক মার ধর করত কারণ সে এলো মেলো চলত। তখনও সে ছিল অন্য শিশুদের খেলার সাথি কি করে সে স্বামীর সংসার করবে সে জ্ঞান টুকু তার ছিলোনা। পায়ে পায়ে তার বয়স বাড়তে থাকে। একদিন সে বুঝতে পারলো সে মা হতে চলছে। কোল জুড়ে তার সন্তান এলো।একে একে এদের লালন পালন করতে হবে তাকে অতি কষ্টে জানান, ‘যদি এত অল্প বয়সে বিয়ে না হত তাহলে স্বামীর সংসারে গিয়ে আরো ভালো থাকতাম। এখন জীবনকে মিশিয়ে দিলাম চাটাইয়ের সাথে’।





কেইস্ স্টাডি - ৫

• কিশোরী নূর নাহারের দুঃখ

কিশোরী নুর নাহার (১৩) আপন মনে চাটাই বানিয়ে যায়। নোয়াখালী সদরের রাহাতালু গ্রামের বাবা মা হারা এক অসহায় কিশোরী মেয়ে। জন্মের পর পরই তার বাবা মা ইহ লোক ত্যাগ করেন। মা শফিয়া খতুনের কথা মনে হলে পৃথিবীর সব কিছু বিষাদ মনে হয়। মাও ছিলো তার চরম দুঃখিনী। মা বাবা মারা যাওয়ার পর ভাইয়ের সংসারে স্থান হয়। ভাইও থাকে ভাইয়ের শশুর বাড়ীতে কিন্তু সেখানে সে ভাইয়ের বোঝা হয়ে থাকেনি। পড়া লেখা করার খুব সখ ছিলো তার। বাড়ির আসে পাশের মেয়েরা যখন দল বেঁধে স্কুলে যায়,তখন তার ইচ্ছা হয় ওদের সঙ্গে দল বেঁধে স্কুলে যেতে। কিন্তু তার অগেই তাকে ঢুকতে হয়েছে জীবনের আরো কঠিন বাস্তবতায়। নূর নাহার জানায় প্রতিদিন তিনটির মত চাটাই সে বানাতে পারে। এজন্য তাকে সকাল সন্ধ্যা কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। প্রতি হাটে চাটাই বিক্রি করে সে এক দেড়শ’ টাকা পায় এতে তার নিজের খরচ কোনো রকমে চলে যায়। নূরনাহার বলে, ‘আল্লাহ আমাকে অসহায় বানিয়ে এ দুনিয়াতে ছেড়ে দিয়েছেন। এখন মা বাবা কে নিয়ে ভাবার কোন সুযোগ নেই। অবুঝ থাকতে মা বাবা মারা যায়। তাদের চেহারা কেমন তারা কেমন ছিল। কে আমাকে ছোট থেকে বড় করল। কে আমাকে আদর যত্ম দিয়ে বড় করল এ প্রশ্ন সব সময় মনের মধ্যে তাড়না করে । আর তখনই অসুস্থ্য হয়ে পড়ি। তখন কেউ বুঝাতে চাইলেও বুঝতে পারিনা, কষ্টে বুক ভেঙ্গে যেতে চায়, যখন মনে হয়,এই পৃথিবীতে মা বাবাকে কোনোদিন আর দেখব না’।
নূর নাহার বলেন,‘বড় ভাইয়ের শশুর বাড়ীতে থাকি চাটাই বানাই। প্রতি হাটে চাটাই বিক্রি করে নিজের জীবন জীবিকা নির্বাহ করি। আমি প্রতি দিন তিনটা পর্যন্ত চাটাই বানাতে পারি। প্রতিহাটে আমার ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা লাভ হয়। আমি আমার নিজ খাওয়া পরার কাপড় যোগাড় করতে হয়। ভাইয়ের শশুর বাড়ীর লোকেরা যেন আমাকে কিছু বলতে না পারে, সেটা আমি খুব খেয়াল রাখি’।
নূর নাহার আপে করে বলে, ‘পড়া শুনা করি নাই। তবে স্কুলে যাওয়ার শখ ছিল। আপনাদের মত কাগজ আর কলম নিয়ে লিখতে আমার খুব শখ হয়। যদি লিখতে পারতাম তাহলে নিজের জীবনী লিখে সবাইকে পড়ে শুনাতাম। এই পৃথিবীটা আমার কাছে অন্ধ মনে হয়। কারণ আমার একটাই কষ্ট, আমার বাবা মা আজ কোথায়। আমি সবার কাছে দোয়া চাই আল্লাহ্ যেন আমার জীবনটা মান সম্মান নিয়ে কাটিয়ে দেয়’।




কেইস্ স্টাডি-৬

• খতিজা বেগমের আপে

খতিজা বেগমের (৩০) যখন বিয়ে হয় তখন সে হোগলা পাতার কাজ জানতোনা। হোগলা পাতা দিয়ে যে চাটাই বানায় এ বিষয়টিও সে আগে জানতোনা। নোয়াখালীর এওজবালিয়ায় যে নারীই বৌ হয়ে আসেনা কেন তাকে চাটাই বানাতে হয়। এটি এ এলাকার রেওয়াজ। আগে ভাগে কেউ যদি না শিখে থাকে তাহলে তাকে এখানের কারো কাছ থেকে চাটাই বুনন শিখে নিতে হয়। খতিজা যখন নতুন বৌ হয়ে রিক্সায় করে হেগলা বনের ভিতর দিয়ে আসছিলো, তখন রিক্সাওয়ালা রিক্সা টানতে টানতে মজা করে বলছিলো, হোগলা পাতা নতুন বৌকে শশুর বাড়ি যেতে দিচ্ছেনা। হোগলা পাতার বনের মধ্যদিয়ে যেত যেতে খতিজা ভাবছিলো, এলাকার নারীদের মত যদি সে হোগলা পাতার চাটাই বানাতে পারতো তবে সে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করতো। খতিজা বেগম বলে ‘ইয়ানে য্যাতেই আইব হেতারেই চাডাই বানাইত অইব। আগে না শিখা থাইকলে অন এতাগোত্তুন শিখতো অইব’। শশুর বাড়িতে এসে দেখে এখানে সব নারীরাই চাটাই বুননে পারদর্শী।
এখন চাটাই বানিয়ে খতিজা খুব সন্তুষ্ট নয়। কারণ সে যদি অন্যদের মত প্রতিদিন ৩/৪ টি চাটাই বানাতে পারতো তাহলে তার খুব আনন্দ হোত। খতিজা সারা দিনে একটাও বুনতে পারেনা। কারন চাটাই বুননে সে তত পারদর্শী নয়। খতিজার বর্তমানে ৩ ছেলে ২ মেয়ে। সে জানায়,‘ তারা আমার থেকে অনেক বেশি ভালো চাটাই বানাতে পারে। তারা ভাই বোন মিলে দিনে ৫/৬ টি চাটাই বানাতে পারে’ । খদিজার স্বামী চায়ের দোকানে কাজ করে। তার সাথে সাথে চাটাই বুনতে খতিজাকে সাহায্য করে। চাটাই বুনা হয়ে গেলে স্বামী বাজারে বিক্রি করে। কখনো কখনো তার বড় মেয়ে রিংকু (১০) বাজারে গিয়ে চাটাই বিক্রি করে আসে। রিংকু প্রাইমারি স্কুলে ৫ম শ্রেণীতে পড়ে। সে চাটাই বুনতে এখন খেকেই অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। চাটাই বানাতে সে মা ও বড়দের সাহায্য করে।



কেইস্ স্টাডি - ৭

• আনোয়ারার সুখের সংসার

নোয়াখালী কালাদরাপ ইউনিয়নের রাহামুড়িতালু গ্রামের আনোয়ারার বিয়ে হয়েছিলো মাত্র তের বছর বয়সে। এ গ্রামেই তারজন্ম। ছোট্ট কাল থেকে সে দেখে আসছে গ্রামের প্রায় সব নারীই চাটাই বানাতে পারে। গ্রামের অনেকেই দল বেঁধে এক সাথে বসে চাটাই এর কাজ করে। এ দৃশ্য দেখে তার খুব ভালো লাগতো। ছোট বয়সেই সে চাটাইয়ের কাজ শিখে নিয়েছে। এ কাজে তাকে বড়রা খুব সহযোগীতা করেছিলো। বিয়ের পাঁচ বছর পরে তারকোল জুড়ে আসে তাদের প্রথম সন্তান। আনোয়ারার স্বামী ছোট একটা চায়ের দোকান করে। সারাদিনের ঘর কন্যার কাজ করে আনু বসে যায় চাটাইয়ের কাজনিয়ে। সারা দিনে সে যে চাটাই বানায় সেগুলো প্রতি হাটে তার স্বামী বিক্রি করে। বিক্রির টাকা তারা অন্য কোনো কাজে খরচ না করে নিজেদের কাছে জমা রাখছে। তাদের ইচ্ছা সে টাকা দিয়ে তারা নতুন টিনের ঘর তৈরী করবে। সে আশায় আশায় তারা দিন গুনছে। আরো স্বপ্ন দেখে কবে তাদের মেয়ে বড় হবে। চাটাই বানানোর টাকা দিয়ে মেয়েকে অনেক দুর পর্যন্ত পড়ানোর ইচ্ছা আছে তাদের। আনু জানায়, ‘স্বামী স্ত্রী মিলে এক সাথে কাজ করলে সংসারে কোনো অভাব থকেনা। দুজনে সমঝোতার মাধ্যমে চলতে পারলে সংসারে উন্নতি লাভ করা যায়’। আনু বলে ,‘গেরামের হোগলা পাতা আঙ্গোরে বাঁচাই রাখছে’। চাটাইয়ের কাজ করতে পেরে সে খুব খুশী। আনু জানায় ,‘আমি এখন খুব সুখী। আমার মনে হয় আমার মত আর কেউ এতে সুখী নয়’।



কেইস্ স্টাডি - ৮

চাটাই বুনে শশুরের ঋণ শোধ করলেন মারজাহান

কষ্টকে মোকাবিলা করতে হলে সংগ্রাম করতে হবে। সে নারী হোক, আর পুরুষ হোক। কথাটা বললেন মারজাহান (২৫)। মারজাহান ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়া লেখা করেছেন। মারজাহান বিয়ের আগে কোন দিন চাটাই তৈরি করে নি। বিয়ের পরে স্বামীর সংসারে এসে দেখতে পায় চাটাই বানানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই। অন্য সকলের জন্য সেও চাটাই বানানোর কাজ হাতে নিল। প্রথমে তার খুব কষ্ট হয় । মারজাহান আরো জানায়, তার শ্বশুরের মৃত্যুর আগে অনেক টাকা ঋণ করে গেছেন। তাদেরকে এ ঋণের বোঝা বইতে হয়েছে। ১৮ হাজার টাকা ঋণ শোধ করতে হবে। এ অবস্থায় মারজাহান গ্রামীণ ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেয় ১০ হাজার টাকা। শর্ত ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের টাকা এক বৎসরে শোধ করতে হবে। মারজাহান চাটাই বানিয়ে প্রতিহাটে তা বিক্রি করতো । এ টাকা জমা করে প্রতি সাপ্তাহে কিস্তিতে শোধ করতো। এভাবে প্রথম বছর ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শ্বশুরের ঋণের টাকা শোধ করলেন। তিনি জানান গ্রামীণ ব্যাংক আমাকে সহযোগিতা করেছে আবার চাটাই তৈরিতেও সহোযোগিতা করেছে। একদিকে সুখী আবার অন্য দিকে অসুখী।
অসুখী কেন জানতে চাইলে বলে, ‘এই যে সারাদিন চাটাই তৈরি করি সাথে অন্য সব কাজ করে থাকি। কোমর ব্যাথা সব সময় লেগে থাকে। ভালো ডাক্তার দেখানোর কোন সুযোগ নেই। ডাক্তারের যে খরচ সে খরচ বহন করার মত স্বামীর আয় নেই। তাই ভালো ডাক্তার দেখাতে পারি না’।
স্বামী বাহার উদ্দিন জানায় আমাদের পড়া লেখা নেই তাই আমরা কোন দিন বড় হতে পারবো না। আমরা এমনই থাকতে হবে। যদি পারি আমাদের
সন্তানদেরকে নিয়ে চেষ্টা করব পড়া শুনা করাবার জন্য।


কেইস্ স্টাডি - ৯

নূরজাহানের দুঃখ জয়ের গল্প

সময় মানুষকে বদলাতে পারে। কিন্তু তার জন্য নীরবে যুদ্ধ করতে হয়। আর এ যুদ্ধ মানুষকে বড় করে। আবার কখনো পতন ঘটায়। তেমনি এক নারী নুরজাহান (৩৫)। জীবন ভর যুদ্ধ করে যাচ্ছে নিজেরই জীবনের সাথে । এক সময় চাটাই বানিয়ে কোন রকমে ৯ সদস্যের পরিবারের ভরন পোষন চলত। এতে যে টাকা পাওয়া যেতো , তাতে নিদেনপে আধমুঠো খাওযার জুটতো কখনো কখনো । পেট ভরে খাওয়ার সুযোগ হয় নি কোনোদিন। একদিন স্বামী আবছার তাকে ডেকে বলে ‘চলো আমরা চিটাগাং চলে যাই, ওখানে আমরা দু’জনে কাজ করবো। সাথে আমাদের বড় ছেলেও থাকবে। আমরা ভালো আয় করতে পারব’। নোয়াখালীর সদরের কালাদরাপ ইউনিয়নের এওজবালিয়া গ্রামের সহজ সরল কুল বঁধূ নুরজাহান স্বামীর সঙ্গে পুরো পরিবার নিয়ে চট্টগ্রাম চালে যায় । সেখানে অজানা অপরিচিত পরিবেশ। প্রথম প্রথম খুব কষ্টের মধ্যে পড়ে তারা। কখনো কখনো প্রতিদিনের খাওয়ারও যোগাড় হতোনা। নুরজাহান নোয়াখালী থেকে যাওয়ার এক বছর পর চট্টগ্রাম নাছিরাবাদ এলাকায় ইট ভাঙ্গার কাজ নেয়। বড় ছেলে রাজ জুগালীর কাজ শুরু করে। এভাবে কোনদিন একশ’ আবার কোন দিন পঁচাত্তর আশি টাকা আয় করতে থাকে। শরীর ভালো থাকলে দুইশ’ টাকাও রোজগার হয়। এ টাকায় প্রতিদিনের খরচ মোটামুটি চলে যায় তাদের।
নূরজাহান বলে, আমি যদি এই চাটাইয়ের উপর নির্ভর থাকতাম তাহলে প্রতিদিনের খাওয়ার নিশ্চিত করতে পারতাম না। তার কষ্টের কথাগুলো বলতে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ফেলে। সংসারের একটু স্বছলতা দেখে স্বামী আবছার তাঁকে রেখে আবার বিয়ে করে ফেলে । এতে নুরজাহান বাধা দিলে সংসারে নেমে আসে অশান্তি। নুরজাহন চিন্তা করেন যদি স্বামীকে বাদ দিয়ে দেই তাহলে লোকে আমাকে খারাপ বলবে, কিন্তু আমার সংসারে শান্তি হবে। তার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী তাকে খুব অত্যাচার করতে থাকে। সতীন তাঁর ভাইদের কে দিয়ে নূরজাহানকে মারধর করে। নূরজাহান সব কিছুকে ঠান্ডা মাথায় মোকাবিলা করে। নূরজাহান সে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরকে বলে কয়ে স্বামীকে আবার সংসারে ফিরিয়ে আনেন। অবস্থার বেগতিক দেখে নূরজাহানের সতীন তাদের ছেড়ে চলে যায়। তার স্বামী অনুতপ্ত হয়ে তার কাছে হাত জোড় করে মা চায় । সে যে ভুল করেছে তা সে বুঝতে পারে। নুরজাহান বলেন, ‘এতেই আমি খুশী’। ভাঙনের মুখোমুখী হয়েও তিনি বিচলিত হননি। অসীম ধৈর্য্য ধারন করে নূর জাহান তার গড়া সংসারকে শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হোলেন। নূরজাহান বলেন,‘আল্লার দুইন্নাইত ম্যাইনসের সংসারের মাইদ্দে ব্যাস-কম ঝামিলাতো আছে, এগুলার লগে যুদ্ধ করি টিকতো না পাইরলে কপালে দুঃখ লই থাইকতে হয়’। অর্থাৎ নূরজহান বলছেন, আল্লার দুনিয়াতে মানুষের সংসারের মাঝে কম বেশী ঝামেলাতো আছে, এর সাথে যুদ্ধ করে টিকতে না পারলে কপালে দুঃখ নিয়ে থাকতে হয়।

কেইস্ স্টাডি - ১০

চাটাই ব্যবসা করে আত্ম নির্ভরশীল

বাপ দাদার আমল থেকে শুরু হল এ কাজ। তাই আমরা আর অন্য কাজে যাই কি ভাবে, হোরন বলে, ‘ছোট্ট বেলা থেকে আমি চাটাই তৈরি করতাম আমার মায়ের সাথে। আমরা দুই ভাই এক বোন। আমি সবার বড়। আমার বয়স যখন ১৮ বছর তখন আমার বাবা মারা যায়। বাবা মৃত্যুর সময় রেখে গেছে একটা ভিটা । তিন ভাই বোন আর মাকে নিয়ে আমাদের সংসার। হোরণ বলে, ‘বাবার চাটাই ব্যবসার হাল ধরতে হল আমাকে। চাটাই বানানো, সংসারের দায়িত্ব , ঋণের বোঝা, সবকিছু ছিল আমার মাথার উপর। সব সময় চিন্তা থাকতো কিভাবে এ সব মোকাবিলা করা যায়।
বাবার মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরে আমি নিজে সাহস করে হাটে গিয়ে ৭ হাজার টাকার চাটাই কিনে আনি। এ চাটাই গুলো নিয়ে যাই সিলেটে, তখন থেকে আমার সাহস বেড়ে যায় এবং ব্যবসার সম্পর্কে মোটামুটি বুঝতে পারি। প্রথম ৭ হাজার টাকায় লাভ হয ২ হাজার টাকা। প্রথম বারই সিলেট থেকে আসার সময় মাস্তানরা আমাকে ধরে সব টাকা নিয়ে যায়। বাড়ীতে এসে যখন মাকে জানালাম মা আমাকে সান্তনা দিয়ে বলেন, ‘আমরা গ্রামীণ ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণনিয়ে আবার ব্যবসা করব’। ঋণ নেয়া হলো ১০,০০০/- টাকা , ৫ হাজার টাকা চাটাই কিনে আর বাকী টাকা থেকে বাবার কিছু ঋণ শোধ করেছি। কিছু টাকা দিয়ে হোগলা পাতা কিনা হলো ঘরে চাটাই তৈরি করার জন্য। মা এবং আমার বোন সে পাতা দিয়ে চাটাই তৈরী করলো। একটি চালান নিয়ে আবারও আমি সিলেটে নিয়ে যাই। এবার আমার টাকায় টাকা লাভ হয় । বাড়ী এসে সব কটি টাকা মাকে দিয়েছি। মা আমার গায়ে হাত বুলিয়ে বলে তোদের বাবা নেই তাতে কি হয়েছে আমার ছেলেতো আছে। আমার মায়ের দোয়ায় আজ আমি অনেক ভালো আছি। আমি আর কোন দিন এক বেলা না খেয়ে ছিলাম না। জীবন আর জীবিকার তাগিদে সংগ্রাম করেছি। আজ নির্দিষ্ট একটা অবস্থানে আছি। কারো মুখাপেক্ষী হতে হয় না। বৌ বাচ্চা আর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে আল্লাহ আমাকে অনেক ভালো রেখেছেন। আমার মত এ রকম যারা আছে আমি তাদেরকে উৎসাহ দিয়ে থাকি। শ্রম দিলে শ্রমের মূল্য পাওয়া যায়। এটা কোন কঠিন বিষয় নয়। যেহেতু আমরা অশিতি। আমাদেরকে শ্রম দিয়ে জীবন বাঁচাতে হবে’।
যদি হোরনের মত অন্য শ্রমজীবী মানুষ সময়ের মূল্য দিয়ে থাকে তাহলে মনে হয় আর কারো দারিদ্রের শিকার হতে হবেনা।



















এক নজরে গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল

 উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী একটি কৃষি প্রধান অঞ্চল। এই জেলার প্রায় এক লক্ষ মানুষ চাটাই শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে যার আধিকাংশই নারী। শিল্প কারখানার দিক দিয়ে নোয়াখালী একটি পশ্চাদপদ জেলা। শিক্ষাদীক্ষায়ও গ্রামীণ নারীরা অনেক পিছিয়ে। দৈনন্দিন ঘর কন্যার কাজ ছাড়া এদের করণীয় কিছুই থাকেনা। তবে সারাদিনের কাজের ফাঁকে ফাঁকে এরা নিত্যপ্রযোজনীয় নানান জিনিষ তৈরী করে থাকে। চাটাই তার মধ্যে অন্যতম। সম্পূর্ন হাতে তৈরী এ পন্যটি ধীরে ধীরে গ্রামীণ শিল্প হিসাবে প্রসার লাভ করেছে। গ্রামীণ নারীরাই এর প্রধান কারিগর।
 গ্রামীণ শিল্প হিসাবে এর প্রসার ঘটলেও এর জন্য কোনো পরিকল্পিত বাজারব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। যুগযুগ ধরে এ শিল্পের সাথে জড়িত থেকেও নারীরা তাদের আর্থিক অবস্থা পরিবর্তন করতে পারেনি।
 আর্থিক অস্বচ্ছলতা,সামাজিক দৈন্যতা,নারীদের প্রতি সামাজিক মূল্যবোধ ইত্যাদির কারণে এখানে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটেনি।তাই এলাকার নারীদের শিক্ষার হারও খুব কম।
 গবেষণা এলাকায় বিভিন্ন এনজিও ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এনজিওদের ঋণ কার্যক্রম মূলত তাদের সূদ ব্যবসার প্রসার ঘটেছে।
 অনেক নারীই এই ঋণের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে আছে। নারীরা তাদের নামে ঋণ নিয়ে স্বামী শ্বশুর ভাই কিংবা ছেলের হাতে তুলে দেয়। এই ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে এর ঘানি টানতে হয় নারীদেরকেই।
 এই ঋণে এরা জর্জরিত হয়ে থাকলেও ঋণ এবং অনুদান সর্বদা এদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। যে কানো আর্থিক টানাপোড়নে এরা ঋণের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
 নারীদের আয়ের পুরো অংশই স্বামী অথবা পরিবারের জন্য খরচ করা হয়। চাটাই বিক্রির টাক নারীরা স্বামীর হাতে তুলে দেয়। চাটাই বিক্রির সামান্য যে টাকাটি পায় তাও তারা নিজেরমত করে খরচ করতে পারে না।
 এলাকার মানুষদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই করুন । ৯৫%পরিবার একেবারেই নিম্ন আয়ের এখানকার পুরুষদের মূল পেশা কৃষি। ঘনবসতি পূর্ণ এই এলাকার অধিকাংশ মানুষের নিজেদের কৃষি জমি নেই। অন্যের জমিতে শ্রম বিক্রি করেই এদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয়।
 এলাকার নারীরা এক সীমাবদ্ধ জীবন যাপন করে যাচ্ছে।এদের জীবন ুদ্র গন্ডির মধ্যে একই চক্রে আবদ্ধ হয়ে আছে।এলাকার সামাজিক কোনো কাজে নারীদের কোনো প্রকারের অংশ গ্রহন নেই।
 এই নারীরা বিশ্বাস করে, পুরুষরাই শ্রেষ্ঠ,নারীদের উপর কতৃত্ব করার অধিকার রয়েছে পুরুষদের। নারীদের সৃষ্টি হয়েছে পুরুষদের সেবাদাসী হিসাবে।
 হাজার কষ্টের মধ্যে থেকেও এরা অসম্ভব পরিশ্রমী ও কাজের প্রতি খুবই নিষ্ঠাবান।
 শহুরে জীবনের নানান সুবিধা বঞ্চিত শ্রমজীবী এ গ্রামীণ নারীরা গ্রামবংলার একটি অতি নগন্য কৃষি পন্য দিয়ে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে অবদান রাখছে অথচ এরা চিরকাল অবহেলিত অবস্থায় লোকচুর অন্তরালে রয়ে গেছে।
 যে পাতা দিয়ে চাটাই তৈরি করা হয় স্থানীয় ভাবে এটি হোগলা পাতা হিসাবে পরিচিত। হোগলা গাছ সাধারনতঃ ১২ থেকে ১৫ ফুট লম্বা হয়ে থাকে।কাঁচা অবস্থায় এর রং থাকে গাড় সবুজ। শুকানো অবস্থায় এর রং হয়ে উঠে গাড় সোনালী। প্রায় এক ইঞ্চি ব্যসার্ধ্যের ত্রিকোনাকৃতির মাংসল পাতা এর প্রধান বৈশিষ্ট্য।
 অন্যান্য পন্যের চেয়ে অনেক সস্তায় সহজে পাওয়া যায় বিধায় নিুবিত্ত ও সাধারন খেটে খাওয়া মানুষ এই চাটাই ব্যপক হারে ব্যবহার করে।
 এ পাতা দিয়ে চাটাই ছাড়াও ঘর তৈরির বেড়া, টুকরী,পাখা, ছোট বাক্স,শিকা,দড়ি,ঘর সাজাবার সৌখিন দ্রব্যাদি, উন্নতমানের হস্ত শিল্প তৈরী করা যায়।
 কোনো প্রকারের কৃত্রিম আঁশ এর সাথে মিশানো হয়না। এটি ১০০% পরিবেশ সম্মত।
 হোগলা গাছ প্রাকৃতিক ভাবে নীচু জলজ সা্যঁতস্যাঁতে মাটিতে আপনাতেই জন্ম নেয়। একবার জন্মালে এটি সহজে মরেনা। গোড়া থেকে কেটে নিলে সেখান থেকে এটি আপনাতেই আবার গজিয়ে উঠে
 এ শিল্পের উন্নয়নের জন্য সরকারী বেসরকারী কোনো প্রতিষ্ঠান কোনো পদপে নেয়নি তবে দু’ একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান হোগলা পাতা দিয়ে তৈরি উচ্চমানের হস্তশিল্প
তৈরী করে বিদেশের বাজারে রফতানী করার চেষ্টা করছে
 চরম দারিদ্রতার মধ্যে জীবন যাপন করলেও এদের মধ্যে রয়েছে এক বিশেষ স্বাতন্ত্র বোধ। গ্রামীণ নারী হয়েও এরা মনে করে সুযোগ ও সহযোগিতা পেলে একদিন এরা অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করতে পারবে।
 কাজের প্রতি একাগ্রতা থাকায় এদের মধ্যে আছে এক অমিত সম্ভাবনা। যেকোনো কাজই এরা খুব আগ্রহ সহকারে করে থাকে।
 নোয়াখালীর কয়েকটি গ্রামীণ বাজার চাটাইয়ের জন্য বিখ্যাত। এ এলাকা থেকে মাসে কোটি টাকার চাটাই দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়
 এলাকার প্রতিটি গ্রামেই হোগলা পাতার বন রয়েছে কোনো জমিতে একবার হোগলা গাছ জন্মালে তা বহু বৎসর পর্যন্ত টিকে থাকে । মাটি থেকে শিকড় সহ মূল উৎপাটন না করলে এর বংশ
 বিস্তার হতে থাকে
 হোগলা পাতা দিয়ে উৎপাদিত পন্য প্রধানতঃ আভ্যন্তরিন বাজারে সরবরাহ করা হয়।
 এখান থেকে ব্যবসায়ীরা সিলেট,ঢাকা , চট্টগ্রাম, রংপুর সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে।
 স্থানীয় ফড়িয়ারাই মূলত চাটাইয়ের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। নারীদের কাছ থেকে কম দামে কিনে এরা অধিক মুনাফায় দেশের বিভিন্ন যায়গায় বিক্রি করে।


গবেষণার আলোকে সুপারিশ

হোগলা পাতার এ শিল্পটির রয়েছে এক উজ্বল সম্ভাবনা। এ থেকে পরিবেশ সম্মত পন্য উৎপাদন হয় বিধায় দেশ বিদেশে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সিলেটের পাহাড়ী জনগোষ্ঠির মধ্যে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। সীমান্তের অপর পাড়ে পাহাড়িদের মাধ্যমে এই চাটাই ব্যাপক হারে পাচার হয়। কুটির শিল্প হিসাবে এর প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে । তবে প্রচারের অভাবে এটি তেমন বিকাশ লাভ করেনি। অংশগ্রহণমূলক কর্মগবেষণায় যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে তা হলো এটিকে ঠিক গতানুগতিক গবেষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে এর একটি সুদূর প্রসারী কর্মসুচী নেয়া প্রয়োজন। মাত্র ৬ মাসের গবেষণায় একদিকে যেমন ছিলো চাটাই শিল্পে জড়িত দরিদ্র নারীদের সামাজিক পরিবর্তনের ভাবনা, তেমনি এই সম্ভাবনাময় উপেতি গ্রামীণ শিল্পের প্রসারের ক্ষেত্রে খুঁজে পাওয়া গেছে অমিত সম্ভাবনার দ্বার। যার অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে অসীম।



এর জন্য প্রয়োজন :

 নারীদের মধ্যে কুটির শিল্প প্রশিণের ব্যবস্থা করা । হোগলা পাতা দিয়ে শুধু চাটাই তৈরী করেই নারীরা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে হাগলা পাতা দিয়ে শুধু চাটাইই নয় নানান আকর্ষনীয় সৌখিন পন্য উৎপাদন করা যায়, যার অনেক বাজার মূল্য রয়েছে। এর দ্বারা গ্রামীণ নারীরা যথেষ্ট লাভবান হতে পারবে।
 ফড়িয়াদের মাধ্যমে উৎপাদিত পন্য বিক্রি না করে নিজেরাই নিজেদের পন্য সুবিধামত বিক্রি করার ব্যবস্থা করা, এর জন্য নিজেদের পুঁজি সৃষ্টি প্রয়োজন। এই নারীদেরকে সচেতনতা মূলক প্রশিণ কিংবা আরো অংশগ্রহণমূলক কর্ম গবেষণার প্রয়োজন, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের সমস্যা নিজরা চিহ্নিত করতে পারবে এবং নিজেরাই তা সমাধন করতে সচেষ্ট হবে।
 চাটাই ছাড়াও ঢাকা ও বিদেশের বাজার সৃষ্টির জন্য নতুন নতুন পন্য তৈরী করার কৌশল সম্মন্ধে সার্বণিক ফলোআপ করা। পরিবেশ পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে সাথে গ্রাহকদেরও রুচির পরিবর্তন ঘটে। বাজার সৃষ্টির লক্ষে মানুষের রুচি অনুযায়ী পন্য উৎপাদন করা প্রয়োজন। এর জন্য পর্যবেণ সেল থাকা প্রয়োজন, অন্ততঃ যত দিন সম্ভব।
 নারীরা যেন নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে এমন সংগঠন তৈরী করার ত্রে সৃষ্টি করে দেয়া। যার মাধ্যমে তারা নিজেরাই আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারবে।
 নারীদের উৎপাদিত পন্য যেন নারীরা নিজেই নিজেদের আওতায় রাখতে পারে তার জন্য নিজেদের নিয়ন্ত্রিত সেল সেন্টারের ব্যবস্থা করা।
 এলাকার শিশুদের প্রায় ক্ষেত্রে গতানুগতিক স্কুলের প্রতি রয়েছে ব্যাপক অনিহা। ৩ থেকে ৫ বৎসরের শিশুদের জন্য আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষামুলক স্কুলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পরবর্তী জীবনে যেন এরা স্বয়ংকৃয়ভাবে স্কুল মুখী ও শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে।






মাহমুদুল হক ফয়েজ রিইব মিলনায়তন,ঢাকা পুরাতন হাসপাতাল সড়ক ৪ এপ্রিল ২০০৫
মাইজদী কোর্ট, নোয়াখালী
ফোন-০৩২১-৬১৪৭০
মোবাইল-০১৭১১২২৩৩৯৯
ঊ-সধরষ- সযভড়বু@নঃঃন.হবঃ.নফ